ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী অনেক কলেজে শুধু ভর্তি ফিই ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে

এবারও নির্ধারিত ফির দ্বিগুণ খরচ লাগছে মেডিক্যালে ভর্তিতে

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

 এবারও নির্ধারিত ফির দ্বিগুণ খরচ লাগছে মেডিক্যালে ভর্তিতে

নিখিল মানখিন ॥ নানা সমালোচনার মধ্য দিয়ে চলছে দেশের বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী দেশের অধিকাংশ বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। অনুমোদন নেয়ার সময় কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়া শর্তসমূহ পরবর্তীতে আর মেনে চলে না অনেক কলেজ। অনেক কলেজের অনুমোদন আছে, হাসপাতাল নেই। শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য পর্যাপ্ত মেডিক্যাল উপকরণ নেই। চলে ভাড়াটে ক্যাম্পাস ও শিক্ষক দিয়ে। নেয়া হয় উচ্চ ভর্তি ফি। কলেজ কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামতো সব কিছু চলে। ডাক্তারি ডিগ্রী পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে কলেজ কর্তৃপক্ষের ওপর। আকাশচুম্বী ভর্তি ফি ও প্রশাসনিক ব্যয় মেটাতে না পেরে মেধা তালিকার প্রথম সারিতে থাকার পরও বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারছেন না অনেক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী। বিগত শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফি, উন্নয়ন ব্যয়, বিধিসহ নামী-বেনামী অনেক খাতের অজুহাত দেখিয়ে চড়া ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। বিগত সময়ে অনিয়ম ও নিম্নমানের শিক্ষাদানের অভিযোগে কয়েকটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে ওসব মেডিক্যাল কলেজে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর ঘটনায় বিব্রত স্বয়ং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের এক সভায় মেডিক্যাল কলেজগুলোর মান নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, প্রতিটি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজকে বিদ্যমান আইনের শতভাগ মেনে চলতে হবে। নিম্নমানের কলেজ থেকে ডিগ্রী নিয়ে বের হওয়া চিকিৎসকরা সমাজের জন্য আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। আর বিএমডিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি অভিন্ন মূল্যায়ন কমিটি গঠন হতে যাচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিছুসংখ্যক বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের কারণে পুরো চিকিৎসা সেক্টর প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ হাসান। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন কারণে পর্যাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না। অনেক বেসরকারী কলেজে শিক্ষক, মেডিক্যাল উপকরণ ও রোগীর সঙ্কট রয়েছে। কিছুসংখ্যক মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতাল পর্যন্ত নেই। হাসপাতাল, রোগী ও পর্যাপ্ত মেডিক্যাল উপকরণ না থাকায় শিক্ষার্থীরা প্র্যাকটিক্যালে পিছিয়ে পড়ে। নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর শিক্ষকদের যোগ্যতা ভালভাবে মনিটরিং করা হয় না। একজন শিক্ষককে শিক্ষাদান ও চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হয়। অনেক সময় শিক্ষা দেয়ার চেয়ে চিকিৎসায় বেশি সময় দিতে হয় শিক্ষকদের। অনেক শিক্ষক একাধিক মেডিক্যাল কলেজে সম্পৃক্ত থাকেন। তিনি আরও বলেন, বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর মান বজায় রাখতে হবে। নিম্নমানের কলেজ থেকে বের হয়ে একজন দক্ষ চিকিৎসক এবং মানসম্মত চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের চিকিৎসকরা অনেক সময় জাতির জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন। ভাড়াটে ক্যাম্পাসে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ থাকে না। নতুন কলেজ অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান অধ্যাপক মাহমুদ হাসান। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ ই মাহবুব জানান, দক্ষ চিকিৎসক সৃষ্টি এবং মানসম্মত কলেজ গড়তে হলে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন রয়েছে। আর তা আন্তরিকভাবেই বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ নিম্নমানের বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে এক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও আরেক সরকার এসে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। কলেজগুলোর ওপর শক্তিশালী ও স্বচ্ছ মনিটরিং ব্যবস্থা থাকলে দেশে দক্ষ চিকিৎসক ও মানসম্মত কলেজ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক রশীদ ই মাহবুব। খসড়া আইনে বলা হয়েছে, খসড়া আইন অনুযায়ী কোন ভাড়া বাড়িতে কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন করা যাবে না। কলেজ একাডেমিক ভবন ও হাসপাতাল ভবন আলাদা থাকতে হবে। কোন অবস্থাতেই দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের ধারণা গ্রহণযোগ্য হবে না। হাসপাতালে দরিদ্র জনগণের জন্য বিনা ভাড়ায় কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ বেড সংরক্ষণসহ ফি চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কলেজে একজন শিক্ষার্থীর বিপরীতে হাসপাতালে থাকতে হবে পাঁচটি শয্যা। সর্বনিম্ন ৫০ ছাত্রছাত্রীর আসনবিশিষ্ট বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের জন্য মহানগর এলাকায় কমপক্ষে কলেজের নামে দেড় একর জমিতে অথবা নিজস্ব জমিতে কলেজের একাডেমিক ভবনের জন্য ১ লাখ বর্গফুট এবং হাসপাতাল ভবনের জন্য ১ লাখ বর্গফুট ফোর স্পেস থাকতে হবে। নির্ধারিত ফি’র দ্বিগুণ খরচ ॥ এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতি বছরের মতো এবারও ভর্তি ফির বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কয়েক বছর ধরে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শুধু ভর্তি ফি ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকা নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অনেক কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতে অনানুষ্ঠানিক অনেক শিক্ষার্থীকে দিতে হয়েছে বাড়তি টাকা। যা কাগজে-কলমে লিখিত থাকে না। প্রথম শ্রেণীর মেডিক্যাল কলেজগুলোয় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতে অনেক শিক্ষার্থী গোপনে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি ভর্তি ফি নিয়ে এবারও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন অনেক মেডিক্যাল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক। গত সেশনের অভিজ্ঞতা তাদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর নিজেদের মতো করে বাড়তি ভর্তি ও কোর্স ফি আদায় করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষার নামে বাণিজ্য বসানোর অভিযোগ উঠে আসছে। বিগত শিক্ষাবর্ষে ভর্তি ফি, উন্নয়ন ব্যয়, বিধিসহ নামী-বেনামী অনেক খাতের অজুহাত দেখিয়ে চড়া ফি আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠানের ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা নিয়মের বিষয়টি দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সরকারী ৩৬ কলেজে ৪ হাজার ৬৮ ও বেসরকারী ৬৯ কলেজে ৬ হাজার ২৩২ আসনসহ মোট ১০ হাজার ৩শ’ আসন রয়েছে।
×