ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘ওপেন্টি বায়োস্কোপ নাইন টেন তেইশস্কোপ...’ মধুময় ছোটবেলা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

‘ওপেন্টি বায়োস্কোপ নাইন টেন তেইশস্কোপ...’  মধুময় ছোটবেলা

সমুদ্র হক ॥ ছেলেবেলার দিনগুলোর মাটির গন্ধে প্রাণের ছোঁয়ার সেই খেলাগুলো এখন কালেভদ্রে চোখে পড়ে। হারিয়েই বুঝি গেল শিশুদের দেহের গঠনের বেড়ে ওঠা সেসব খেলা। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ঘরের আঙিনা, নদীর ঢেউ, গাছগাছালি ঝাউবন, নীল আকাশে মেঘের ভেলা, ভরা চাঁদের পূর্ণিমা, শুকতারা, দূরের আলোকছটার কোন গ্রহ দেখে অনেক খেলা শেখে। নগরীর শিশুরা কংক্রিটের আস্তরে ঢাকা বিকেলের সোনাঝরা রোদটুকুও দেখতে পায় না। গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধে আনন্দের সেসব খেলা ওরা কোথায় পাবে! অরূপের অন্ধকার থেকে মর্তে আগমনের সঙ্গে শিশুর ওপর আলোর বিন্দু এসে ঝরে পড়ে রূপের জগতে। জন্ম হয় চেতনার। উপলব্ধির মন্ত্রে বলে ওঠে ‘মা, মা গো আমি এলাম তোমার কোলে, তোমার ছায়ায় তোমার মায়ায় মানুষ হবো বলে...’। মা শিশুকে কোলে আগলে চাঁদকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সুর তোলেন ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা.....’। অপার স্নেহে বেড়ে ওঠা শিশু মায়ের কোল থেকে নেমে হাঁটি হাঁটি পা পা করে পৌঁছে কৈশোরের উচ্ছলতায়। কৈশোরের দুরন্তপনার দাপট এতটাই বেড়ে যায় যে ওদের কাছে সব অসম্ভবই সম্ভব, সব অগম্যই গম্য। ওরা গেয়ে ওঠে ‘আমি রাজি রাখো বাজি এক ডুবে ভরা নদী হয়ে যাব পার...’। এমন ধারায় বেড়ে ওঠা শিশুরা আঙিনায়, স্কুলের মাঠে, সদ্য ধান কাটা জমির নাড়ার ওপর আপন খেয়ালে ছুটাছুটি লুটোপুটি করে এগিয়ে যায় তারুণ্য। এরা যখন যা মনে করে তাই খেলে। তারুণ্যে বয়ঃসন্ধির যে জেন্ডার রিলেশন্স নিয়ে ভাবা হয় শিশুকালেই তা প্রকৃতির নিয়মেই গড়ে ওঠে। শিশুকালে ছেলেমেয়ে এক সঙ্গে খেলে। হারজিৎ নির্ণয় হয় একই ভাবে। কতই না খেলা- কাগজের উড়ো জাহাজ বানিয়ে উড়িয়ে দেয়া, নৌকা বানিয়ে জলে ভাসিয়ে দেয়া আরও কত কি! এভাবে শিশু মনের সুপ্ত ভাবনাগুলোও প্রকাশ পায়। উড়োজাহাজ উড়িয়ে ভাবত সুদূর নীলিমায় উড়ে যাবে সে কোন একদিন। এ খেলার নাম- বৌ ছি। কেউ মনে মনে বৌ সেজে দৌড় দেয়। ছুঁয়ে দিলেই বিজয়। কানামাছি ভোঁ ভোঁ যারে পাবি তরে ছোঁ... এই খেলা খেলেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ‘ওপেন্টি বায়োস্কোপ নাইন টেন তেইশকোপ’... মধুময় খেলার কথা মনে পড়লে কে না নস্টালজিক হয়। কোমরে হাত দিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে রেলগাড়ি খেলার সেই ছড়া কি ভোলা যায় সহজে- আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম.......। দড়ি খেলা (দুই হাতে দড়ি ধরে ওপর নিচে ঘুরিয়ে নিতে পা দড়িতে না লাগা) ছিল মেয়েদের বড় আনন্দের খেলা। ছোট গাছের ত্রিকোণ শাখা কেটে রাবার পেঁচিয়ে ছোট্ট টুকরো বসিয়ে ছুড়ে দিয়ে বাটুল খেলা। আবার গাছের শাখা একটু চেঁছে তার সামনে কাঠের টুকরো ফেলে ছুড়ে দিয়ে একধরনের চেঙু পানটি খেলা। মেয়েরা আঙিনায় মইয়ের মতো ঘর এঁকে মাটির হাঁড়ির ভাঙ্গা টুকরো ফেলে কুত্্কুত্্ শব্দে এক পা ধরে এগিয়ে যাওয়ার খেলা ছিল আনন্দের। দাঁড়িয়াবান্ধা খেলা না খেললে শিশু জীবনই যেন বৃথা। মোরগ লড়াইর খেলার কথা মনে হলে এখনও হাসি পায়। এক হাত দিয়ে এক পা টেনে তুলে আরেক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করে তোলা যে কি আনন্দের। হা-ডু-ডু (বর্তমান নাম কাবাডি) গ্রামীণ জীবনের খেলা থেকে বর্তমানে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে স্থান পেয়েছে। গ্রামের মাঠে এমন কি কাদামাটিতে নেমে এই খেলা যৌবনের শক্তিকেই তুলে ধরত। ছেলে বেলার সেই দিনগুলোর এক খেলা মার্বেল। পকেটে দুইটা মার্বেল নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যে অনেকগুলো মার্বেল নিয়ে ফিরত তার দেমাগ দেখে কে! খেলার এমন কিছু শব্দ যা শুনলে আজও হাসি পায়। যেমন নট আউটকে বলা হতো নটপটকে। ছোট্ট গর্তে মার্বেল ফেলতে না পারলে বলা হতো- গুচ্চি মিস এগেইন। মার্বেল খেলে বাড়িতে পিটুনি খায়নি এমন কাউকে পাওয়া যাবে কি! প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মুখোমুখি বসে পায়ের ওপর পা তুলে তার ওপর হাতের কয়েক আঙুল উঁিচয়ে ঝাঁপ দিতে বলা হতো। গ্রামে কত রকমের যে খেলা...। একটা সময় রেল লাইনের ধার দিয়ে টেলিফোনের তারের পোলের সঙ্গে কান পেতে শোঁ শোঁ শব্দ শোনাও ছিল এক ধরনের খেলা। লুকোচুরি খেলা শিশুদের চিরন্তন খেলা হয়ে আছে। কতই না খেলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গ্রামে। এসব ছোট্ট ও মধুময় আনন্দের খেলা নিয়েই বেড়ে ওঠে শিশু। সেই শিশু বড় হয়ে উৎসব পার্বণে বা দেশ বিদেশের কোথাও একে অপরের সঙ্গে দেখা হলে কতই না স্মৃতিকাতরে ভরে ওঠে সেই ক্ষণ। তখন মনে হয় জীবনের সবচেয়ে বড় সুখের অনুভূতি সেই ছোট্ট বেলার দিনগুলো। যেখান থেকে মানুষ নিজেকে ভাবতে শেখে। যেমন একজন মেয়ে শিশু খেলনাপাতি হাঁড়ি পাতিল পুতুল ইত্যাদি নিজের সম্পদ বলে মনে করে। যতœ করে। আগলে রাখে। পুতুল খেলা নিজেকে চিনতে শেখায়। ছেলেরাও পথে ঘাটে ঘুরে ঘুরে অনেক ধরনের খেলায় নিজেদের ভাবতে শেখে। এভাবেই এগিয়ে যায় মানব জীবন চক্র। রবীন্দ্রনাথের সুরে ভেসে ওঠে ‘খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি মনেরও গভীরে.....’।
×