ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনেও প্রাধান্য পাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনেও প্রাধান্য পাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যু

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার ঘটনা নিয়ে বিশ্বজুড়ে নিন্দা ও নানামুখী চাপ সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি জাতিসংঘে এবারের সম্মেলনেও অংশ নিচ্ছেন না। তার বদলে সে দেশের দুই জ্যেষ্ঠমন্ত্রীর অংশ নেয়ার কথা রয়েছে বলে সেখানকার বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এ তথ্য প্রকাশ করেছে শনিবার। অপরদিকে, এবারের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বিশ্বের পাঁচ প্রভাবশালী দেশ রোহিঙ্গা সঙ্কট তুলে ধরে বিস্তারিত আলোচনার প্রস্তুতি নিয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকটি দেশ এ অধিবেশনে রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানের প্রত্যাশা জানাবে বলেও তথ্য প্রচার হয়েছে। ফলে এবারের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সঙ্কটই আলোচনায় প্রাধান্য পাবে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে তথ্য দিয়েছে। এদিকে, রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের প্রায় ১৪ মাস অতিবাহিত হওয়ার পথে। কিন্তু মিয়ানমার পক্ষ এসব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সমঝোতা স্মারক চুক্তি সম্পাদন করেও রহস্যময় নীরবতা পালন করে চলেছে। উল্টো দোষ চাপিয়েছে বাংলাদেশকে। আগে বলেছিল ওরা বাঙালী। বাংলাদেশ থেকে সেদেশে অবৈধভাবে বসতি গেড়েছিল। পরে বলেছে, বাংলাদেশ পক্ষ প্রস্তুত ছিল না বলে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। যা ছিল সুচির ডাহা মিথ্যা একটি উক্তি। আবার সর্বশেষ মিয়ানমার নেত্রী আশিয়ান নিয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্মেলনে বলেছেন, সৃষ্ট রোহিঙ্গা সঙ্কট আরও ভালভাবে সামাল দিতে পারত তার সরকার। বিশ্লেষকদের বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, মূলত অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন নিপীড়ন, হত্যা, গুম, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের দেশান্তরি করার পর এখন প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা বলছে ঠিকই, কিন্তু সবই যেন এক নাটকের ভূমিকার মতো দৃশ্যমান হচ্ছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হওয়ার পর মিয়ানমার সরকার রাখাইন রাজ্যে কোন দেশের প্রতিনিধি বা সাহায্য সংস্থাকেও যেতে দেয়নি। এর পাশাপাশি সে দেশের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে পারে। অসহায় এ জনগোষ্ঠীর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ মানবিক কারণে তাদেরকে অনুপ্রবেশে কোন বাধা দেয়নি। বরঞ্চ আশ্রয় দিয়ে প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে, যা এখনও চলছে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে দফায় দফায় নানা আলোচনা হয়েছে এবং সব মহলে স্বীকৃত হয়েছে রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, যার কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারকে কাঠগড়ায় আনার উদ্যোগ চলছে। সেনাবাহিনী দিয়ে সুপরিকল্পিকতভাবে এ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সুচি সরকার। বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার পর মিয়ানমারের পাঁচ সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবি জোরালো হয়েছে। এর পাশাপাশি স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচির বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সুচির পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলের সামনে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার বক্তব্য দেয়ার প্রক্রিয়াটিও রীতিমতো তিরোহিত। একদিকে আন্তর্জাতিক চাপ ও প্রচ- সমালোচনার মুখে থাকার কারণে আউং সান সুচি শেষ পর্যন্ত এবারের অধিবেশনে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বলে সে দেশের বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তা প্রচার করেছে। তার পরিবর্তে যাবেন জ্যেষ্ঠমন্ত্রী কিয়াও টিন্ট শোয়ে ও কিয়াও টিন। মিয়ানমার স্থায়ী সচিব মিন্ট থু সে দেশের গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন, দুই মন্ত্রী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতার অগ্রগতি নিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনকে অবহিত করবেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, গত বছরও রাখাইনে রোহিঙ্গাবিরোধী সংঘাত শুরুর প্রেক্ষাপটে আউং সান সুচি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দেননি। জাতিসংঘের এবারের সাধারণ অধিবেশন আগামী ২৩ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন বাংলাদেশ জাতিসংঘের সঙ্গে পৃথক চুক্তি সই করেছে। আন্তর্জাতিক চাপে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকল্পে গত বছরের নবেম্বর মাসে বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর করে মিয়ানমার। চুক্তি স্বাক্ষরের পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অদ্যাবধি একজন রোহিঙ্গাকেও তারা ফেরত নেয়নি। স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি এ বিষয়ে এ নিয়ে দোষ চাপিয়েছেন বাংলাদেশের ওপর। অথচ, বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম দফায় ৮০৩২ জন রোহিঙ্গার একটি তালিকাও হস্তান্তর করা হয়েছে মিয়ানমার পক্ষকে। ওই তালিকা যাচাই করতে সময়ক্ষেপণ হয় দুই মাসেরও বেশি। ওই তালিকা থেকে মাত্র ৭ শতাধিক রোহিঙ্গাকে নেয়ার ইঙ্গিত দেয়া হয়। উখিয়া টেকনাফে বর্তমানে নতুন পুরনো মিলিয়ে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার আশ্রয় রয়েছে। ৩০ শিবিরে অবস্থানকারী এসব রোহিঙ্গাদের নিয়মিত ত্রাণ সহায়তাও পর্যাপ্তভাবে দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে উত্তর রাখাইনে নির্ধারিত কিছু এলাকা পরিদর্শনের জন্য জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে অনুমতি দেয়া হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও উন্নয়ন কর্মসূচী ইউএনডিপির চারটি দলকে দুসপ্তাহ অবস্থান করার সুযোগ দেয়া হয়। এ দলের সদস্যদের ২৩টি স্বতন্ত্র গ্রাম ও ৩টি গ্রাম্য ওয়ার্ড পরিদর্শনের অনুমতিও দেয়া হয়। রোিহঙ্গাদের স্বেচ্ছা ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতকরণে গত জুন মাসে জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর এটাই এ ধরনের প্রথম পদক্ষেপ। এর আগে গত বছরের আগস্ট থেকে রাখাইনের মংডু এলাকায় ইউএনএইচসিআর-এর একটি কার্যালয় থেকে সেই কার্যালয়ের সদস্যদের মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। এদিকে, আসন্ন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স ও মালয়েশিয়া রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে জোরালোভাবে তৎপরতা চালানোর প্রস্তুতি নিয়েছে। এর পাশাপাশি, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, আলজিরিয়া, মরক্কো, সুদানসহ বিভিন্ন দেশও রোহিঙ্গা সঙ্কট জাতিসংঘে তুলে ধরার প্রস্তুতি নিয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু থেকেই এর সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে রাখাইন অভিযানে অংশ নেয়া রোহিঙ্গাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ রয়েছে। জাতিসংঘের এবারের অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোরালো ভূমিকা পালন করবে বলেও আশা করছে কূটনৈতিক মহল। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক সচিব জেরেমি হান্ট ইতোমধ্যে বলেছেন, জাতিসংঘ অধিবেশনে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখার জন্য তাদেরও তৎপরতা চলছে। অধিবেশন চলাকালে যুক্তরাজ্য মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আয়োজন করবে, যেখানে রোহিঙ্গা সঙ্কটই প্রাধান্য পাবে। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে কানাডা সরকারের পক্ষ থেকেও বিশেষ দূত নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কানাডার বিশেষ দূত বব রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর শেষে ইতোমধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করেছেন। জাতিসংঘের এ অধিবেশনকে সামনে রেখে কানাডা সরকারের বিশেষ প্রস্তুতি দৃশ্যমান। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড সেখানকার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে তার দেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। জাতিসংঘ অধিবেশনে কানাডা এ সঙ্কট নিয়ে জোরালো বক্তব্য দেবে। অপরদিকে, ফ্রান্স ও মালয়েশিয়া অনুরূপ ভূমিকা নেবে। এ অধিবেশনের আগেই গত ১২ সেপ্টেম্বর ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) সংসদীয় প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে। ইতোমধ্যে ফিরে গিয়ে তারা নিজ নিজ দেশের সরকারের কাছে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট পেশ করেছে। সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পক্ষ থেকে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা সঙ্কট তুলে ধরা হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পক্ষে গত বছর জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৫ দফা পেশ করেছিলেন। এবারের অধিবেশনেও বাংলাদেশের পক্ষে তিনিই সঙ্কট সমাধানে তার সরকারের ভূমিকা ও পরামর্শ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২১ সেপ্টেম্বর এ অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওয়ানা দেবেন বলে সরকারী সূত্রে জানানো হয়েছে। পুশব্যাক ॥ রোহিঙ্গাদের আরও একটি দলকে বিজিবি পুশব্যাক করেছে। গত শুক্রবার এ ঘটনা ঘটে। মিয়ানামর থেকে নাফ নদী পেরিয়ে ইঞ্জিনচালিত দুটি নৌকাযোগে ২০ রোহিঙ্গার দুটি দল অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। তারা শাহ পরীর দ্বীপ গোলারচর এলাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কিন্তু খবর পেয়ে বিজিবির পক্ষে তাৎক্ষণিক তাদের পুশব্যাক করা হয়। টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ অধিনায়ক মেজর শরীফুল ইসলাম জোমাদ্দার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
×