ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সংসদ নির্বাচনের আগেই রোহিঙ্গাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সংসদ নির্বাচনের আগেই রোহিঙ্গাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। ইতোমধ্যে সরকারী পর্যায়ে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে যাবতীয় প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। এ পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে যে তথ্য মিলেছে সে অনুযায়ী ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ নির্বাচনে কক্সবাজার অঞ্চলের মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নতুন পুরনো মিলিয়ে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাড়তি একটি ঝামেলা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে আগেভাগেই এরা যাতে নির্বাচনকালীন কোনভাবেই কোন ধরনের অপতৎপরতায় অংশ নিতে না পারে সে লক্ষ্যে কঠোর ব্যবস্থা আরোপ করতেই হবে। উখিয়া টেকনাফের ৩০ রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে অস্ত্রধারী ও সন্ত্রাসীদের তৎপরতা রয়েছে তার প্রমাণ মিলছে। বৃহস্পতিবার ভোরে হ্রীলা লেদা ক্যাম্পের ডি ব্লক থেকে পুলিশ অস্ত্র ও ইয়াবাসহ রোহিঙ্গা ডাকাত জহির আহমদকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এই জহিরের মতো আরও বহু সন্ত্রাসী ডাকাত হিসেবে পরিচিতি অনেকেই ঘাপটি মেরে রয়েছে। এদের সঙ্গে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রও রয়েছে। মূলত এরা আরাকান বিদ্রোহী বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসব সংগঠনের পক্ষে এদের হাতে আগেই তুলে দেয়া হয়েছে নানা জাতের অস্ত্র। প্রাপ্ত অস্ত্র নিয়ে অনেকেই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। দীর্ঘদিন অবস্থানের কারণে এপার ওপারের এদের যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন। রোহিঙ্গাদের যেহেতু আইন অমান্যের স্বভাব রয়েছে এবং এদের বড় একটি অংশ চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার ক্যারিয়ার হিসেবেও জড়িত সে কারণে এদেরকে শৃঙ্খলায় রাখতে এখনই প্রশাসনিক তৎপরতা প্রয়োজন। যার মধ্যে রয়েছে ক্যাম্প অভ্যন্তর ছাড়া বাইরে চলাফেরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রাখা। এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুমতি বাধ্যতামূলক করা। এছাড়া ৩০ শিবিরের প্রতি কক্ষ বা বসতিতে পুলিশের নিবিড় পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান থাকছে । কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে সারা রাত সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয় এসব শিবির। যে কারণে ইতোমধ্যে হত্যা, গুম, অপহরণ, জিম্মি করাসহ নানাবিধ ঘটনা ঘটেছে। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রণজিত কুমার বড়ুয়া জানিয়েছেন, ডাকাত জহিরকে গ্রেফতারের পর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্প পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের একটি যৌথ টিম হ্নীলা জাদিমুরা শাল বাগান নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ের কাছাকাছি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। আটকের পর তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পুলিশ দল হৃীলা লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি এলজি, একটি একনলা বন্দুক ৪ রাউন্ড কার্তুজ ও ৭ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে। আশ্রয় শিবিরগুলোতে খুন, মাদক, অস্ত্র প্রদর্শনসহ রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধ তৎপরতা ব্যাপক শঙ্কা সৃষ্টি করেছে স্থানীয় মহলে। এ নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে দুশ্চিন্তার কমতি নেই। গত সোমবার কুতুপালং শিবিরে পরিচালিত অভিযানে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত থাকার দায়ে ৭ রোহিঙ্গাকে ভ্রাম্যমাণ আদালত দ- দিয়েছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের চাকমারকুলের পাহাড়ী এলাকা থেকে গলাকাটা ৩ রোহিঙ্গাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর ওই দিন বিকেলে উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় নিখোঁজ আরও ৩ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। এর আগে ৩১ আগস্ট এক রোহিঙ্গা যুবককে গুলি করে হত্যা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। গত ১৯ জুন উখিয়ার বালুখালী-২ ময়নারঘোনা আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গা নেতা আরিফ উল্লাহকে গলা কেটে হত্যা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি রাতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে বালুখালীর তাজনিমারঘোনা আশ্রয় শিবিরের মাঝি মোঃ ইউসুফকে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ অতি সহজেই স্বল্প অর্থে অপরাধে জড়িয়ে যায়। ভাড়ায় খাটে। আগামী নির্বাচনে এসব রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোনভাবেই যেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টতা না ঘটে তা নিয়ে এখন থেকেই যাবতীয় প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। ওরা আশ্রিত। বাংলাদেশ মানবিক কারণে ওদের আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয় ক্যাম্প এবং শরণার্থী শিবিরে যারা রয়েছে তাদের চলাচলে যেসব নিয়ম কানুন দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তারা কঠোরভাবে পালন করতে বাধ্য হয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ভাসানচরে লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া এগোচ্ছে ॥ উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রথম দফায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের সরকারী প্রক্রিয়া জোরালো গতিতে এগিয়ে চলছে। এককভাবে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এ কাজ এগিয়ে চলছে। আগামী মাসের প্রথমার্ধে খোদ প্রধানমন্ত্রী ভাসানচরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আবাসন প্রকল্পের উদ্বোধন ঘোষণা করার কথা রয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। সুচির বোধোদয় না নতুন চাল ॥ বৃহস্পতিবার ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে আশিয়ানের ওপর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ফোরামে (ডব্লিউইএফ) বক্তৃতা দিয়েছেন মিয়ানমারের এনএলডি নেত্রী আউং সান সুচি। বক্তৃতায় তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলেছেন। বলেছেন, রাখাইন ইস্যু আরও ভালভাবে সামাল দিতে পারত সরকার। রোহিঙ্গা ইস্যুতে দীর্ঘদিন নেতিবাচক মনোভাবে থাকার পর এ বক্তব্যের মাধ্যমে তার বোধোদয় ঘটেছে নাকি এটি তার নতুন চাল তা নিয়ে জিজ্ঞাসার সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, সুচি শুরু থেকে এ সঙ্কট সমাধানে বাংলাদেশের কথিত অসহযোগিতার কথা বলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ হন্যে হয়ে গত এক বছর ধরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সফলও হয়েছে। যে কারণে মিয়ানমার বিশ্বজুড়ে সমালোচিত। সমালোচনার অগ্রভাগে রয়েছেন সুচি নিজে। ডব্লিউইএফ-এর সম্মেলনে বক্তৃতায় সুচি বলেছেন, দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে সকল পক্ষের প্রতি আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। সে জন্য কারা আইনের শাসনে সুরক্ষিত থাকবে তা আমরা নিজেরা নির্ধারণ করতে পারি না। বক্তৃতাকালে তিনি বলেন, তার দেশের সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে পরিস্থিতি যে কোন পন্থায় আরও ভালভাবে সামাল দিতে পারত। এতদিন পর এটা কি সুচির বোধোদয়- এ প্রশ্নও এখন উঠেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের দুই সাংবাদিকের কারাদ- প্রসঙ্গে সুচির বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওইদিন সাজা পেয়েছেন আইন লঙ্ঘনের কারণে। তবে তারা আপীল করতে পারবেন। তবে তিনি এও বলেন, এ দ-াদেশ আইনের শাসন বজায় রেখেছে এবং এতে বাক স্বাধীনতার কোন ক্ষতি হয়নি। উল্লেখ করা যেতে পারে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। সে দেশের সেনাবাহিনীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথাও বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও বলেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত ঘটনা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কিনা সে বিষয়ে তদন্ত করা যেতে পারে। সুচি তার বক্তব্যে জাতিসংঘের প্রতিবেদন নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি।
×