ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তাঁত শিল্পের সুদিন ফিরছে

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৯ আগস্ট ২০১৮

তাঁত শিল্পের সুদিন ফিরছে

আনোয়ার রোজেন ॥ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোরাই ধন’ গল্পের নায়িকা সুনেত্রা। ভালবাসত কালো পাড়ের সাদা জমিনের শাড়ি। বলত, ‘দিশি তাঁতীর হাত, দিশি তাঁতীর তাঁত, এই আমার আদরের।’ সুনেত্রার চোখে তাঁতীরা শিল্পীও বটে। ‘তাদেরই পছন্দে সুতো, আর আমার পছন্দ সমস্ত কাপড়টা নিয়ে।’ এটাও জানা কথা, এক সময়ের আদরণীয় এই দেশী তাঁত ও তাঁত শিল্পীরা আজ অনেকটা বিলুপ্তির পথে। বিগত ৫শ’ বছর ধরে বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের ৬০ থেকে ৮০ ভাগ সুতি বস্ত্রের চাহিদা মিটিয়ে এখন তাঁত শিল্পের হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সেই তাঁত এবং তাঁতীদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পাওয়ার লুমের আধিপত্যের কাছে হ্যান্ডলুম হার মানলেও এখনও অভ্যন্তরীণ বস্ত্র চাহিদার ৪০ ভাগ জোগান আসছে তাঁত শিল্প হতে। সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২টি ইউনিট তাঁতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। এমন প্রেক্ষাপটেই প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে খাতটির আধুনিকায়নে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে ১১৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে নেয়া হয়েছে একটি প্রকল্প। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ ১৫ বছর পর তাঁতীদের আর্থসামাজিক অবস্থার হালনাগাদ তথ্য জানতে নেয়া হয়েছে শুমারির উদ্যোগ। মাঠ পর্যায়ে তাঁত শুমারি-২০১৮ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের আওতায় ৫টি বেসিক সেন্টারে ৫টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ১টি ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউট এবং ২টি মার্কেট প্রমোশন কেন্দ্র স্থাপন হবে প্রকল্পের মূল কাজ। প্রকল্পের আওতায় তাঁত অধ্যুষিত এলাকায় পাঁচটি প্রশিক্ষণ সেন্টার স্থাপন করা হবে। এলাকাগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার, টাঙ্গাইল সদর, সিরাজগঞ্জ সদর, বগুড়া জেলার কাহালু এবং কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী। উল্লেখ্য, এই ৫টি বেসিক সেন্টারের নিজস্ব জমি থাকায় নতুনভাবে জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন বা এ সংক্রান্ত কোন ব্যয়ের প্রয়োজন হবে না। শুধু পূর্ত নির্মাণ এবং লজিস্টিক সাপোর্ট সরবরাহের মাধ্যমে এ ৫টি কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ প্রদান করা সম্ভব হবে। ফ্যাশন ডিজাইন ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হবে জামালপুরের মেলান্দহে। এছাড়া ঢাকার কাওরান বাজার এবং কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, তাঁতের সুদিন ফেরাতে আরও উদ্যোগ নেয়া হবে। দেশের যেসব স্থানে তাঁত শিল্প রয়েছে, সেগুলোর জন্য আরও প্রকল্প নেয়ার নির্দেশ ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, সিলেটের মনিপুর এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাঁত শিল্প বিকাশে শীঘ্রই প্রকল্প নেয়া হবে। প্রকল্প সূত্র জানায়, বর্তমান বাজার পদ্ধতির কারণে প্রান্তিক তাঁতীরা দুইভাবে তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রথমত, মহাজনদের কাছ থেকে তারা উচ্চমূল্যে সুতা ক্রয় করেন। দ্বিতীয়ত, এ সুতা থেকে উৎপাদিত পণ্য বিক্রিও করতে হয় কম দামে। উপযুক্ত বাজার থাকলে তারা পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। এটি করা হলে দেশে-বিদেশে তাঁত শিল্পীদের আত্মকর্মসংস্থান এবং তাঁত বস্ত্রের ব্যবহার বাড়ার মাধ্যমে জনপ্রিয় হবে। ফলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে অধিক অবদান রাখতে পারবে এটি। সূত্র জানায়, ৫টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে প্রতি বছর দেড় হাজার জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ফ্যাশন ডিজাইন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট হতে প্রতি বছর ৫০ জনকে ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রী, ২৪০ জনকে সার্টিফিকেট কোর্স প্রশিক্ষণ এবং ১৫০ জনকে শর্ট কোর্স প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করা সম্ভব হবে। বর্তমানে তাঁত বোর্ডের অধীনে ৩২টি বেসিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে নরসিংদী, পাবনা, সিলেট এবং রংপুরে রয়েছে ৪টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এ ৪টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বছরে ১ হাজার ৪০০ জন তাঁতীকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে। সব মিলে বছরে এ খাতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে। সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটির মাঠ পর্যায়ের বাস্তবায়ন কাজ শীঘ্রই শুরু হচ্ছে বলে জানা গেছে। ১৫ বছরের বিরতি দিয়ে হচ্ছে তাঁত শুমারি ॥ এদিকে তাঁত শিল্পের বর্তমান অবস্থা ও এর সঙ্গে জড়িতদের আর্থ-সামাজিক চিত্র তুলে আনতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ১০ মে থেকে দেশজুড়ে শুমারির মূল কার্যক্রম শুরু করে। সঠিক পরিসংখ্যান এই শিল্প ও শিল্প সংশ্লিষ্টদের উন্নয়নে সরকারের জন্য সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। জানা গেছে, ১৯৯০ সালে প্রথম তাঁত শুমারি পরিচালনা করে বিবিএস। ২০০৩ সালে পরিচালিত হয় দ্বিতীয় তাঁত শুমারি। ১৯৯০ সালের জরিপের প্রতিবেদনের সঙ্গে তুলনা করে জানা যায়, দেশে তাঁতের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। ১৯৯০ সালে দেশে তাঁতের মোট ২ লাখ ১২ হাজার ৪২১টি ইউনিট ছিল। ২০০৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২টি। এ হিসাবে দুই শুমারির মধ্যবর্তী সময়ে তাঁতের সংখ্যা কমেছে প্রায় ২৯ হাজার। জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের ৬০ জেলায় এক যোগে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলেছে। এর আগে প্রাথমিকভাবে পরিচালিত জোনাল অপারেশন থেকে জানা গেছে, বাগেরহাট, ভোলা, চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলায় তাঁত নেই। আগের দুই শুমারিতে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের আর্থ-সামাজিক চিত্র উঠে আসেনি। এবারের শুমারিতে তা উঠে আসবে। এছাড়া শুমারির মাধ্যমে দেশে বিদ্যমান তাঁত সংখ্যা, তাঁত শিল্পে নিয়োজিত লোকসংখ্যাভিত্তিক মোট তাঁত পণ্য উৎপাদন, কাউন্টভিত্তিক সুতার চাহিদা, তাঁতীদের বিদ্যমান সমস্যা, মূলধন, বিপণন ব্যবস্থা, তাঁত শিল্পের ভবিষ্যত সম্ভাবনা উঠে আসবে। সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতিতে এ শিল্পের সামগ্রিক উন্নতির লক্ষ্যে কর্মসূচী গ্রহণ ও দেশের তাঁত খাত সম্পর্কিত একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধ তথ্যভা-ার সৃষ্টি হবে বলে জানান তিনি। উল্লেখ্য, হস্তচালিত তাঁত শিল্প বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কুটির শিল্প। জাতীয় কর্মসংস্থানের দিক থেকে কৃষি ও গার্মেন্টস শিল্পের পরেই তাঁত তৃতীয় বৃহত্তম খাত। আর গ্রামীণ কর্মসংস্থানের দিক থেকে কৃষির পরে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। হস্তচালিত তাঁত ও পাওয়ার লুম মিলে এ খাতে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ লোক নিয়োজিত আছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
×