ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিন বদলের গল্প এখন জেলে নৌকায়

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ১৮ আগস্ট ২০১৮

 দিন বদলের গল্প এখন জেলে নৌকায়

রশিদ মামুন, পায়রা থেকে ফিরে ॥ রামনাবাদের বুকে তখন সন্ধ্যা নামার প্রস্তুতি চলছে। পটুয়াখালীর পায়রা তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রের অস্থায়ী জেটিতে বাঁধা জেলে নৌকা। ছোট্ট নৌকার ওপর সোলার প্যানেল। ভেতরে তাকাতেই দেখা গেল রান্না চলছে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস এলপিজিতে। জেলে আবুল কালাম মোল্লা জ্বালনি আর বিদ্যুত ব্যবহারে পরিবর্তনের গল্প শোনালেন। জানালেন বদলে যাওয়া সময়ের কথা। অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার মধ্যেই জলের জীবনেও লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। কালাম সেই ছোট বেলা থেকে নৌকার হাল ধরেছে। রামনাবাদ, আন্ধারমানিকের বৈরিতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বেড়ে ওঠা। অনেক দেখেছেন ৫০ পেরুনো জীবনে। একসময় নৌকা চালাতে হতো পালের হাওয়াতে। প্রকৃতির হেয়ালি থেকে বেরিয়ে এসেছেন অনেক আগেই। জেলে নৌকায় লেগেছিল ইঞ্জিন। ভেবেছিলেন এইতো অনেক কিছু। কিন্তু এর পরের গল্পটা আরও এগিয়ে চলার। এই বদল অবশ্য খুব বেশি দিন হয়নি। গত কয়েক বছর জুড়ে ধীরে ধীরে জেলের জীবনের পরিবর্তনের গল্প জানাতে গিয়ে বললেন, আগে কাঠের চুলাতে রান্না করতেন। অনেক সময় বৃষ্টির জলে কাঠ ভিজে যেত। ফলে রান্না করা কঠিন হয়ে পড়ত। বাজার থেকে ছোট এলপিজি’র সিলিন্ডার কিনে নৌকাতেই চুলা বসিয়েছেন। এখন দিব্যি রান্না হয় এলপিজিতে। গত এক বছর এলপিজিতেই তিনি রান্না করছেন। আর গত দুই মাস হয় মাথার ওপর সোলার প্যানেল বসিয়ে নিয়েছেন। হঠাৎ সোলার প্যানেলের বুদ্ধিটি মাথায় কি করে এল জানতে চাইলে বলেন, বাসা বাড়িতে যেহেতু সোলার বসিয়ে বিদ্যুত হয় নৌকায় কেন নয়। সেই বুদ্ধি থেকে গত দুই মাস আগে কেরোসিনের কুপি বাতিকে বিদায় জানিয়ে সোলার প্যানেল বসিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের আলোচিত চরিত্র কুবেরকে নিশ্চই মনে আছে সকলের। সংসারের অভাব-দারিদ্র্য ও দুঃখ-বেদনাদগ্ধ কুবের অজগ্রাম কেতুপুরের বাসিন্দা ছিল। জেলের জীবনের পরতে পরতে কষ্ট আর কষ্টের মাঝেও প্রেম কুবেরকে এনে দিয়েছিল জনপ্রিয়তা। আর আজকের আধুনিক এক কুবের হচ্ছেন আবুল কালাম মোল্লা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কুবেরদের জীবন বদলে দিয়েছেন আবুল কালাম মোল্লারা। লাগাম টেনে ধরেছেন হতাশার। প্রযুক্তিকে আপন করে নিয়েছেন বলেই এগিয়ে গেছেন। আবুল কালাম তার নৌকার ছই (চাল) এর ওপর যে সোলার প্যানেল বসিয়েছেন তার দাম এক হাজার ২০০ টাকা। এর সঙ্গে চার হাজার টাকার ব্যাটারি। সারাদিন সূর্যের আলোতে থাকে প্যানেলটি। রাতে ব্যাটারির চার্জে জ্বলে বাতি। অনেক দূর থেকে এই বাতি চোখে পড়ে তাই দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থাকে না। দূর থেকে জেলে নৌকার বাতি দেখে বড় নৌযান তাদের এড়িয়ে যায়। আর চার হাজার টাকায় এলপিজির চুলা বসালে শুধু মাসে মাসে একটা সিলিন্ডার কিনলেই হয়। সিলিন্ডারের দামও আহামরি বেশি নয়। কাঠ কেনা শুকানো এ সবের ঝামেলা যেমন নেই তেমনি একবারে রান্না বসিয়ে অন্য কাজও করা যায়। সব সময় চুলার দিকে নজর না দিলেও চলে। সারাদেশে ছোট বড় যেসব নৌযান রয়েছে চাইলেই তারাও সোলার প্যানেল ব্যবহার করতে পারেন। এতে কেরোসিনের বাতি ব্যবহারের আর প্রয়োজন পড়বে না। ইতোমধ্যে দেশের হাওড় এলাকাতে ছোট ছোট নৌকায় সোলার বিদ্যুত ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে প্রচারণা চালালে কেরোসিন ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সাশ্রয়ী হওয়া সম্ভব। আবুল কালাম জানালেন, এখানের অনেকেই এখন সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করছেন এমনকি এলপিজিতে অন্য জেলেরা রান্নাও করছেন। ব্যবহার সুবিধাজনক বলেই অনেকের আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। দেশে ৬০ লাখের বেশি সোলার হোম সিস্টেম বসেছে। যা সারা বিশে^র মধ্যে একটি বড় উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া এলপিজির দ্রুত সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এখন সারাদেশের সব উপজেলাতো বটেই গ্রামেও এলপিজির সিলিন্ডার পাওয়া যায়। ফলে কোন সংগ্রহ প্রক্রিয়া কঠিন কোন বিষয় নয়।
×