ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সতেরো শতকের স্থাপত্য

তিন শ’ বছরের সাক্ষী, ভক্তের পদচারণায় এখনও মুখর

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৪ আগস্ট ২০১৮

তিন শ’ বছরের সাক্ষী, ভক্তের পদচারণায় এখনও মুখর

বিশ্বজিৎ মনি ॥ ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনে সমৃদ্ধ উত্তরের নওগাঁ জেলার অন্যতম পুণ্যভূমি স্থাপত্যের মধ্যে নওগাঁর মান্দা উপজেলার ঠাকুর মান্দা শ্রীশ্রী রঘুনাথ জিঁউ মন্দিরটি প্রায় তিন শ’ বছর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সতেরো শতকের অন্যতম স্থাপত্যের মধ্যে এটি। এখনও চৈত্র মাসের বাসন্তী পুজোর নবমী তিথিতে রামনবমী উৎসবে ১৫দিন ধরে চলে এখানে নানা ধর্মীয় উৎসব ও মেলা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি তীর্থস্থান হিসেবেও ব্যাপক পরিচিত ভারত উপমহাদেশে। বাসন্তী পুজোর শুরু তথা ষষ্ঠি থেকে নবমী এবং এর ৯দিন পর লক্ষণভোজের মধ্যদিয়ে টানা ১৫ দিনব্যাপী ধর্মীয় উৎসব চলে মহা ধুমধামের মধ্যদিয়ে। এই উৎসবে বিশেষ করে রামনবমী উৎসবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ভক্তবৃন্দ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও ভক্তরা আসেন ঠাকুর দর্শনে ও তাদের মানত দিতে। হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভক্তের পদচারণায় এখনও মুখরিত হয়ে থাকে মন্দিরের চারপাশের প্রায় ১ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে। শত শত বাস, মাইক্রোবাস, জীপ আর হাজার হাজার ভ্যান ও ভটভটিতে চড়ে ভক্তরা আসেন এই রঘুনাথ মন্দিরে। মন্দির থেকে কমপক্ষে দেড় কিঃমিঃ দূরে রাখতে হয় এসব যানবাহন। ভক্ত-দর্শনার্থীদের ভিড়ে প্রাচীন এই মন্দির মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রতিবছর রামনবমী উৎসবে নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী ঠাকুর মান্দায় শ্রীশ্রী রঘুনাথ জিঁউ মন্দির প্রাঙ্গণে নেমে আসে নারী-পুরুষ ভক্তের ঢল । কীর্তন, প্রসাদ বিতরণ, ভক্তদের পুজো-অর্চনা, ভোগ নিবেদন এবং মানত দেয়ার মধ্যদিয়ে প্রায় দু’সপ্তাহ উৎসবমুখর হয়ে থাকে এই মন্দির প্রাঙ্গণ। আর শেষদিনে লক্ষণভোজের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়। জয় কৃষাণ-আলো রানী দম্পতি। পুরান ঢাকার বংশাল এলাকার বাসিন্দা। এ দম্পতির জমজ দুই পুত্র সন্তানের বয়স প্রায় তিন বছর। বয়স বাড়লেও তারা তখনও দাঁড়াতে পারছিল না। অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। অবশেষে নওগাঁর ঠাকুর মান্দার রঘুনাথ মন্দিরে এসেছিলেন মানত করতে। প্রিয়াঙ্কা দে এবং নিত্যানন্দন দে দম্পতি এসেছিলেন ভারতের উত্তর চব্বিশপরগনা থেকে। তাদের বিশ্বাস, রঘুনাথ মন্দিরে মানত দিয়েই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে জন্মান্ধ একমাত্র সন্তান রঘুনাথ দে। জেলা শহর থেকে ৪০কিঃমিঃ পশ্চিমে মান্দা উপজেলার এই ঠাকুর মান্দা গ্রামের অবস্থান। এক সময় এই মন্দিরের চারধারে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছিল শুধু বিল। মন্দিরের পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শিব নদী। এক সময় এই নদী ছিলেএ স্রোতস্বিনী। এই নদীতে ভক্ত দর্শনার্থীরা গঙ্গাস্নান করে ভেজা কাপড়ে পাশের বিল থেকে পদ্মপাতা তুলে মাথায় দিয়ে মন্দিরে যেত ঠাকুর দর্শনে। এখনও কিছুটা হলেও ভক্তরা সেই রীতিনীতি মেনে চলার চেষ্টা করেন। নদী এবং বিলে পানি না থাকলেও ভক্তরা মন্দির সংলগ্ন পুকুরে স্নান করে ভেজা কাপড়ে কেউ কেউ আবার এলাকায় দুর্লভ পদ্মপাতা সংগ্রহ করে তা মাথায় দিয়ে তার ওপর মাটির পাতিল বোঝাই ভোগের মিষ্টান্ন মাথায় নিয়ে দীর্ঘ লাইন ধরে প্রভুর চরণে নিবেদন করে থাকেন। কেউ কেউ এক সপ্তাহ ধরে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী মাঠেই আস্তানা গাড়ে। সেখানেই রান্না করে খেয়ে তারা সেখানেই অবস্থান করে। প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৭৮০ সালে নাটোরের মহীয়সী রানী ভবানী মান্দার এই রঘুনাথ মন্দির নির্মাণ করেন। এর গঠন পিরামিডাকৃতির। মন্দিরের সম্মুখে ডরিক স্তম্ভবিশিষ্ট অর্ধবৃত্তাকার বারান্দা আছে। মন্দিরটি সপ্তদশ শতকের হলেও এর অভ্যন্তরে স্থাপিত বিগ্রহগুলো অনেক পুরনো। এই বিগ্রহগুলো প্রাপ্তির বিষয় নিয়ে নানা মত রয়েছে। কেউ বলেন, মান্দার বিল খননকালে রাম, লক্ষণ, সীতা ও রামভক্ত হনুমানের বিগ্রহগুলো পেয়ে ওই মন্দিরে স্থাপন করা হয়। কিংবদন্তি রয়েছে, ওই গ্রামে বাস করতেন দরিদ্র এক অন্ধ ব্রাহ্মণ। তিনি খুবই রামভক্ত ছিলেন। একদিন তিনি বিলে স্নান করতে যান। সেখানে স্নানে নামলে বিগ্রহগুলো বিলের পানিতে ভাসতে ভাসতে এসে তার শরীরে স্পর্শ হয়। তখন তিনি প্রণাম করে মূর্তিগুলো মাথায় ও কোলে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে স্থাপন করেন। সেখানে প্রতিদিন ৩ বেলা পুজো অর্চনা করতে শুরু করেন। এক পর্যায় তিনি দৃষ্টি এবং সাংসারিক সচ্ছলতাও ফিরে পান। তখন থেকেই রঘুনাথের মাহাত্ম্যের কথা চারদিকে প্রচার হতে থাকে। বাড়তে থাকে ভক্তদের ভিড়। এক পর্যায়ে প্রভুর মাহাত্ম্যের কথা পৌঁছে নাটোরের রানী ভবানীর কানে। তিনি ঠাকুর মান্দায় পৌঁছে মন্দিরের জীর্ণতা দেখে নিজেই মন্দির তৈরি করে দেন। সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনও প্রতিবছর জন্মান্ধ শিশুদের শুইয়ে রাখা হয় মন্দিরের সামনে। মানত করা হয়, স্বর্ণের চোখ ও নানা রকম ভোগরাগ। যাদের চোখ ভাল হয় বা দৃষ্টি ফিরে পায় তারা প্রতিবছর এসব মানত দিয়ে থাকে। অন্ধ তথা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের মন্দিরের সামনে শুয়ে রাখার পর অনেক শিশুর চোখ ভাল হয়ে যায় বলে স্থানীয় লোকজন জানায়। মানত দিতে আসা ভক্তরাও ঠিক এমন কথাই বলেছেন।
×