ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২০১৪ সালে ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে জেএমবি জঙ্গীরা তাকেসহ ৪ জনকে ছিনিয়ে নেয় ;###;তাকে ধরিয়ে দিতে পরে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয় ;###;ভারতে পালিয়ে গিয়ে আস্তানা গাড়ে এবং নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নেয়

বোমারু মিজান গ্রেফতার ॥ ভারতে জঙ্গী বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৮ আগস্ট ২০১৮

বোমারু মিজান গ্রেফতার ॥ ভারতে জঙ্গী বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান

গাফফার খান চৌধুরী ॥ পুলিশ হত্যা করে প্রিজনভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেয়া নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবির দুর্ধর্ষ জঙ্গী বোমারু মিজান ভারতে গ্রেফতার হয়েছে। সোমবার ভারতের বেঙ্গালুরু শহরের একটি গোপন আস্তানা থেকে সে দেশের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) বোমারু মিজানকে গ্রেফতার করে বলে জানানো হয়। বোমারু মিজান গ্রেফতারের পর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন পর্যায়ে যোগাযোগ চলছে। গ্রেফতারের পর পরই বাংলাদেশ পুলিশের কাছে বোমারু মিজানের ছবি পাঠায় এনআইএ। পুলিশ ছবি দেখে সে বাংলাদেশের মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গী বোমারু মিজান বলে এনআইএকে নিশ্চিত করে। বোমারু মিজানকে পশ্চিমবঙ্গে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের জঙ্গী নেটওয়ার্ক এবং আগামী ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবসে এবং ভারতের জাতীয় দিবসে জঙ্গীদের নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। জনকণ্ঠকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের এন্টি টেররিজম বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১৫ আগস্ট ভারতের জাতীয় দিবসে জঙ্গীদের নাশকতা চালানোর আশঙ্কা থেকে সে দেশটিতে জঙ্গীবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলছে। সেই অভিযানে গত ৩ আগস্ট এনআইএ’র একটি দল মুর্শিদাবাদ জেলার এলিজাবাদের বাসিন্দা আব্দুল করিম ওরফে ছোটা ও পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের কোত্তাক্কালের বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে শাহিন ওরফে তুহিনকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে শক্তিশালী বিস্ফোরক উদ্ধার হয়। তাদের ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাদের এনআইএ’র আদালত ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। রিমান্ডে পাওয়া তথ্য মোতাবেক গত শনিবার ভারতের বেঙ্গালুরুর মালাপ্পুরাম জেলার কোতাক্কালের একটি আস্তানা থেকে বোমারু মিজানকে গ্রেফতার করে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। বোমারু মিজান বেশ কয়েকবার মালাপ্পুরাম সফর করেছে। সে সেখানে আরও কয়েকজন জঙ্গীকে থাকার ব্যবস্থা করেছে। বোমারু মিজানের আস্তানা থেকে বেশ কিছু ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও কিছু বোমা তৈরির উপকরণ উদ্ধার হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের এন্টি টেররিজম বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে আরও জানান, বোমারু মিজানকে গ্রেফতার করার পর পরই আনুষ্ঠানিকভাবেই বাংলাদেশ সরকারকে ভারত সরকার জানিয়েছে। বোমারু মিজানকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বিশেষ করে আগামী ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবস এবং ভারতের জাতীয় দিবস পালিত হবে। দিবসটিকে ঘিরে জঙ্গীদের হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখে দুই দেশেই জঙ্গীবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলছে। অভিযানের আগে দুই দেশের মধ্যে দুর্ধর্ষ জঙ্গীদের একটি বিশেষ তালিকা হস্তান্তরিত হয়েছে। সেই তালিকা মোতাবেক দুই দেশই অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং সে দেশটির জাতীয় তদন্ত সংস্থা সে দেশের বেঙ্গালুরুতে অভিযান চালায়। অভিযানে সন্দেহভাজন জঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশী নাগরিক জেএমবি জঙ্গী জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে গ্রেফতার হয়। ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেয়া তালিকা মোতাবেক সে দেশের গোয়েন্দারা গ্রেফতারকৃত বোমারু মিজান দুর্ধর্ষ বাংলাদেশী জেএমবি জঙ্গী বলে নিশ্চিত হন। বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে গ্রেফতারের পর ভারতীয় গোয়েন্দারা বোমারু মিজানের একটি ছবি বাংলাদেশ পুলিশের কাছে পাঠায়। পুলিশের তরফ থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী বাংলাদেশের মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গী বোমারু মিজান বলে নিশ্চিত করা হয়। বোমারু মিজানের বিষয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সর্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত আছে। এন্টি টেররিজম প্রধান বলছেন, বোমারু মিজানকে বাংলাদেশের জাতীয় শোক দিবস ও ভারতের জাতীয় দিবসে জঙ্গীদের হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বাংলাদেশ সর্ম্পকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা বাংলাদেশকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অবহিত করছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বোমারু মিজানকে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক সর্ম্পকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এ ছাড়া জেএমবির অস্ত্র গোলাবারুদের উৎস, টাকার উৎস, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের কত জঙ্গী কোন কোন দেশে আছে, তাদের কার্যক্রম কোন পর্যায়ে, বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ, জালরুপী ও জালটাকার ব্যবসাসহ নানা বিষয়ে বোমারু মিজানকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই বোমারু মিজান সর্ম্পকে তথ্য পেতে ভারতে যাচ্ছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি দল। তারা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তায় বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করবে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা দলটি ত্রিশাল থেকে তাকেসহ তিন জঙ্গীকে ছিনিয়ে নেয়ার বিষয়ে আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করবে। প্রসঙ্গত, গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশের প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করে জেএমবি জঙ্গীরা বোমারু মিজান (৩৯), জেএমবির শুরা সদস্য দুর্ধর্ষ জঙ্গী রাকিবুল হাসান ও সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮) এবং বোমা বিশেষজ্ঞ মিজানকে (৩৫) ছিনিয়ে নেয়। পালানোর পথে ওইদিনই মির্জাপুরে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে রাকিবুল হাসান নিহত হয়। বোমারু মিজান ও সানিকে ধরিয়ে দিতে বাংলাদেশ পুলিশ প্রত্যেকের জন্য ৫ লাখ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করে। বোমারু মিজান ভারতে আত্মগোপন করে সেখানেই জেএমবির আস্তানা গাড়ে। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে জেএমবির আস্তানায় বিস্ফোরণে দুই জেএমবি জঙ্গী শাকিল আহাম্মদ ওরফে শাকিল গাজী ও সোবাহান ম-ল ওরফে সোবাহান শেখ নিহত হয়। নিহত দুই জঙ্গীর স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ভারতীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো। দুই নারীর দেয়া তথ্য এবং তদন্তে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশী জেএমবি জঙ্গী কাওসার ওরফে বোমারু মিজান খাগড়াগড়ের আস্তানাটি গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান কারিগর। পরবর্তীতে ভারতের এনআইএ বোমারু মিজানই কাওসার বলে নিশ্চিত হয়। ভারত সরকার খাগড়াগড় হামলার আসামি হিসেবে কাওসারকে ধরতে ১০ লাখ রুপী পুরস্কার ঘোষণা করে। ইতোপূর্বে ভারত সরকারের তরফ থেকে বাংলাদেশের কাছে ১১ ভারতীয় জঙ্গীর তালিকা আর বাংলাদেশের তরফ থেকেও ৪১ বাংলাদেশী জঙ্গী ও সন্ত্রাসীর তালিকা ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেই তালিকায় রয়েছে বোমারু মিজানের নাম।
×