ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একদার বনফুল নয়নতারা

ফুলে গন্ধ নেই, সুরে ছন্দ নেই- এ তো ভাবতেই পারি না...

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৪ আগস্ট ২০১৮

ফুলে গন্ধ নেই, সুরে ছন্দ নেই- এ তো ভাবতেই পারি না...

সমুদ্র হক ॥ এই ফুলে গন্ধ নেই, আছে সৌন্দর্যের উপমা। গুণাগুণও আছে অনেক। গোলাপী রঙের পাঁচটি পাপড়ির এই ফুলের নাম নয়নতারা। একদা ছিল বনফুল। এখন মানুষের চোখে ধরে লোকালয়ের অনেক বাগানে প্রবেশ করেছে। তাকালে মানুষের চোখের নাচনের মতোই মনে হয়। বৃষ্টির সময় এই ফুল দেখলে মনে হবে রিমঝিম ছন্দে নেচে নেচে কথা কইছে। আশা ভোঁসলের কণ্ঠের একটি গান আছে ‘ফুলে গন্ধ নেই এ তো ভাবতেই পারি না, সুরে ছন্দ নেই এ তো ভাবতেই পারি না...’। এই গানের মতো করে বলা যায় নয়নতারায় গন্ধ নেই, তবে এই ফুল মানব জীবনের ছন্দ এনে দিয়েছে। নয়নতারা। আরেক অর্থে- চোখের তারকা। ফুলের এমন বাংলা নাম কে দিয়েছে তা জানা যায় না। এই ফুলের ইংরেজী ও বিজ্ঞানী নাম আছে অনেক। কোন বাঙালী এতগুলো নাম পড়ে কোন কিনারা করতে না পেরে ফুলের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার পর হয়তো নাম দিয়েছেন ‘নয়নতারা’। সেই থেকে দেশে নয়নতারা নামেই পরিচিতি পেয়েছে। হালে বিজ্ঞানীরা এই ফুল গবেষণা করে নানা ধরনের রোগের প্রতিষেধক খুঁজে পেয়েছেন। নয়নতারা ফুল অনেক রঙের। হালকা বেগুনীর প্রলেপে গোলাপী নয়নতারা চোখে পড়ে বেশি। এ ছাড়াও লালচে, সাদার মধ্যে লাল, গোলাপীর মধ্যে হলদে নয়নতারার দেখা মেলে কালেভদ্রে। বাড়ির ধারের জঙ্গলে নদী তীরের ঝাউবনে, কোন বনে অনাদরেই বেড়ে ওঠে এই ফুল। বর্তমানে দেশের অনেক পার্কে, কোন প্রতিষ্ঠানের বাগানে, ব্যক্তি উদ্যোগের বাগানে, বাড়ির টবে নয়নতারা ফুল ফুটছে। পুষ্পপ্রেমীদের কাছে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, গাঁদা, কেয়া ও অন্যান্য সুবাসের ফুলের যেমন কদর নয়নতারার কদর তেমন নেই। যে কারণে গাছে এই ফুল নিরাপদ। কেউ ছিঁড়ে না। ফুলপ্রেমীরা শুধু চোখে দেখেই সৌন্দর্য উপলব্ধি করে। হৃদয়ের রোমান্টিকতায় নিজেকে ভরিয়ে তোলে। ব্রিটেনে এই ফুলকে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যের (ইউকে) রয়েল হর্টিকালচার সোসাইটি এই ফুলকে বাগানের সৌন্দর্যের ফুলের অনন্য পুরস্কার দিয়েছে। তারা বলেছে ফুলটি একই সঙ্গে ‘অর্নামেন্টাল ও হারবাল’। যদিও এই ফুলের কিছু অংশে আছে বিষ, তারপরও বিষে বিষক্ষয়ের মতো এই ফুল অনেক রোগের প্রতিষেধকের কাজ করে। ফুল, পাতা ও ডালে মূল্যবান রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আছে ভিনাক্রিস্টন, ভিনব্লাস্টিন যা এক ধরনের এলকালয়েড। এই দুই উপাদান লিউকোমিয়া রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীগণ বলছেন নয়নতারায় ৭০ ধরনের এলকালয়েড (উপ-ক্ষার) এবং ডেল্টা ইহোহিম্বিন নামের এক ধরনের রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গেছে। ক্রিমিরোগ, মধুমেহ, রক্তপ্রদাহ, সন্ধিবাত, বহুমূত্রসহ কয়েকটি রোগের প্রতিরোধে এই ফুলে ওষুধ তৈরি হচ্ছে। হালে ক্যান্সার চিকিৎসায় এই ফুলের কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। গ্রামে বোলতা মৌমাছির কামড়ের জ্বালা মেটাতে হুল ফোটানোর স্থানে এই ফুল ও পাতার রস ব্যবহার করা হয়। নয়নতারার বহুমুখী কার্যকারিতায় চিকিৎসা বিজ্ঞানে বড় আসন করে নিয়েছে। এই ফুলের আদি উৎপত্তিস্থল মাদাগাস্কার। বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এই ফুল ফোটে। বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাথারানথাস রুজিয়াস। এটি এ্যাপোসাইনাসি ওলিয়েন্ডার পরিবারের বর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। বিভিন্ন স্থানে নানা নামে পরিচিত। যেমন- কেপপেরিউইঙ্কেল, মাদাগেসিয়ার, পেরিউইঙ্কেল, সাদাফুলি, সাদাবাহার, সাদাসোহাগ, সাদাসিনাগান। নয়নতারার দুইটি প্রজাতি এই দেশে মেলে-ভিনকা রোজিয়া ও ওয়েস্টইন্ডিজ। ওয়েস্টইন্ডিজ প্রজাতির নয়নতারা বেশি দেখতে পাওয়া যায়। গাছ ২ থেকে ৩ ফুট (৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার) উঁচু। এদের কান্ড কালচে বেগুনী। পাতা আয়তকার। গোড়ার দিকে অনেকটা ডিম্বাকার। প্রায় ভর বছর ফুল ফোটে। ফুলটি সাদা চোখে পাঁচ পাপড়ির এক রঙের মনে হলেও মধ্যবিন্দুতে গাঢ় রঙের ফোটা থাকে। ৩ থেকে সাড়ে ৩ সেন্টিমিটার চওড়া এই ফুলের দলনল সরু। বীজ ভূমিতে পড়লে আপনাআপনি গাছ গজিয়ে ওঠে। বাড়ির টবে নিজস্ব বাগানে এই ফুলের যত্ন না নিলে গাছটি শক্ত হয়ে যায়। তখন ফুল ফোটে না। নয়নতারা গাছ অনেক বছর টিকে থাকে। নয়নতারা মানুষের মণিকোঠায় নয়নমণি হয়েই আছে।
×