ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্থায়ী পুনর্বাসন ছাড়া কোন বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ৩০ জুলাই ২০১৮

স্থায়ী পুনর্বাসন ছাড়া কোন বিকল্প  নেই

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম ॥ কোথাও জোড়া লাগানো, কোথাও মনুষ্য হতে বিচ্ছিন্ন, কোথাও ন্যাড়া মাথা সদৃশ্য, কোথাও চূড়া থেকে নির্মিত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ভবন। আবার কোথাও অর্ধকর্তিত অঙ্গের মতো বিবর্ণ। চট্টগ্রাম শহরজুড়ে এমন পাহাড়ের সংখ্যা শতাধিক। এসব পাহাড়ের অধিকাংশ পাদদেশে দুই লক্ষাধিক সহায় সম্বলহীন জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই বসবাস ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এরা স্বদেশেই এক ধরনের উদ্বাস্তু। কেউ বা বানবাসি, কেউ নদীসিকস্তিÑ নদী ভাঙ্গা এলাকা থেকে বাড়িঘর হারিয়ে আগত। আবার কেউবা জীবিকার তাগিদে গ্রাম ছেড়ে ভিড় জমিয়েছে শহুরে জীবনে। এদের অধিকাংশ হতদরিদ্র অর্থাৎ কুলি, মজুর, রিক্সা-ট্যাক্সিচালক, কাজের বুয়া, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিক সম্প্রদায় গোষ্ঠীভুক্ত। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত এরা। নগরের প্রাণকেন্দ্রগুলোতে বসবাসের সুযোগ এদের জন্য তিরোহিত। ফলে স্বল্প ভাড়ার মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে এরা নিয়ত বাধ্য হচ্ছে মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার স্পটগুলোকেই। বহু আগে থেকেই এদের অনেকে নিজ উদ্যোগে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নির্মাণ করেছে ছাপড়াযুক্ত ঘর। দিন যতই গড়িয়েছে বেড়েছে এই সংখ্যা। সব মিলে হয়েছে একেকটি বিরাট বস্তি। এই সুযোগে এলাকার মাস্তান, প্রভাবশালীদের অনেকে অবৈধভাবে পাহাড়ের পাদদেশ দখলে নিয়েছে। নির্মাণ করে দিয়েছে সারি সারি বস্তি। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে সংযোগ পেতে সক্ষম হয়েছে বিদ্যুত, গ্যাস এমনকি ওয়াসার পানি সংযোগ লাইনও। ভাড়াও কম নয়। এক কক্ষ বা এর অধিক এ জাতীয় বস্তিঘরের ভাড়া হাজার থেকে কয়েকগুণ বেশিতেও হয়ে আছে। সারা বছর এরা তাদের জীবনযাত্রায় ভাল মন্দ নিয়েই থাকে যাপিত জীবন। কিন্তু বর্ষা মৌসুম এলেই চলে আসে উটকো ঝামেলা। ভারি বর্ষণে বিভিন্ন স্থানে ধসে যায় পাহাড়। আবার ধসের আশঙ্কাও প্রচার হয়। থাকে তটস্থ। এ অবস্থায় প্রশাসন হয় তৎপর। চলে উচ্ছেদ। বিদ্যুত, গ্যাস ও ওয়াসা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার এক মহাযজ্ঞ দৃশ্যমান হয়। এর ওপর প্রশাসনিক নির্দেশ আসে সরে যেতে। কিন্তু যাবে কোথায়? বলা হয় নিরাপদ স্থান। নিরাপদ স্থান বলতে সাইক্লোন শেল্টার, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা অঙ্গন অভ্যন্তর। যা সম্পূর্ণ অস্থায়ী। আর একবার নিজস্ব আবাস ছেড়ে গেলে হারিয়ে যায় সর্বস্ব। নিঃশেষ হয়ে যায় ওরা। বুলডোজারে চাপা পড়ে তাদের স্বল্পমূল্যের সম্পদ বা বিভিন্ন সামগ্রী। আর লুটেরা দলতো রয়েছেই। নিমিষেই সর্বস্ব হয়ে যায় উধাও। তাই মৃত্যুর চরম ঝুঁকি নিয়েও এরা সরে না। সরতে মন সায় দেয় না। প্রশাসনের সিদ্ধান্তের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করে। অধিকাংশ পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মচারী। একজনের আয়ে তো সংসার চলে না। তাই স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই শ্রম দিতে হয়। দৈনিক বা মাস আয়ের জন্য। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও চট্টগ্রামে বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়ার কঠোর নির্দেশনা এসেছে। প্রতিদিন চলছে মাইকিং। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে চলছে অভিযান। তছনছ হয়ে যাচ্ছে অভাবী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বস্তির সংসার। কখনও এরা রুখে দাঁড়াতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তেড়ে ওঠেন। মাঝে মাঝে অবস্থান হয়ে যায় মুখোমুখি। এসব নিয়ে প্রশাসনের নির্দেশনায়ও রয়েছে রকমফের। একদিকে বলা হয় কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না। অন্যদিকে বলা হয় অনেকের প্রাণরক্ষার্থে উচ্ছেদ অভিযানের উদ্যোগ। হতদরিদ্ররাও বুঝে তাদের প্রাণ রক্ষার্থে যত প্রয়াস। কিন্তু ভবিষ্যত কি? কোথায় হবে নতুন সংসার। কিভাবে আবার তিলে তিলে গড়ে তুলবে নিজেদের আগের অবস্থান। অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে ক’দিনইবা থাকা যাবে। কদিনই রিলিফ সামগ্রীর যোগান পাওয়া যাবে। অবৈধভাবে পাহাড় ওরা যেমন কাটেনি, তেমনি বস্তিঘরও গড়ে তোলেনি। এই অবৈধ কর্মকা- করেছে প্রভাবশালীদের একটি অংশ। ভাড়া স্বল্পমূল্যের হওয়ায় মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে এসব স্থানে তাদের জন্য কপালে লিখন হয়ে আছে। দিনে বা মাসে যে আয় হয় সে অর্থের সামান্য অংশ দিয়ে নিজেদের পছন্দসইভাবে যে সংসার গড়ে তোলে মূলত সেটি অনিশ্চিত এবং যন্ত্রণাময় এক জীবন। তবুও এদের জীবন থমকে থাকে না। থাকে চলমান। বস্তিতে থেকে ওরা তাদের সন্তান সন্ততির লেখাপড়াও করায়। এটাই ওদের জীবন ধারা। এ প্রক্রিয়ায় অনেকে আবার হারিয়েও যায়। কিন্তু প্রাণরক্ষার্থে সাময়িকভাবে অন্যত্র আশ্রয় নিলে নিমিষেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পথ থেকে ওঠে আসা এসব মানুষের ঠিকানা হবে আবারও সেই পথ। তাইতো ওরা প্রাণ হারানোর ভয় নিয়েও ঝুঁকিপূর্ণ স্থান ছাড়তে নারাজ।
×