ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ আদিবের স্কুল

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২১ জুলাই ২০১৮

গল্প ॥ আদিবের স্কুল

আদিব উদাসভাবে বারান্দার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঢাকায় আসার পর থেকে সারা দিন সে এই কাজটাই করে। এখানে আসার পর থেকে তার দম বন্ধ লাগে। বারান্দায় এলে একফালি আকাশ দেখা যায়। বড় বড় বিল্ডিংয়ের ফাঁকে এক টুকরো ভাঙা আকাশ। ওই আকাশটার দিকে তাকিয়ে একটুখানি শান্তি খোঁজে ছোট্ট আদিব। আদিব ঢাকায় আসতে একদমই রাজি ছিল না। কিন্তু আব্বুর বদলির কারণে আসতেই হলো। এখানে আসার পর থেকে সারা দিনই মনমরা হয়ে বসে থাকে সে। আদিবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মু পেছনে এসে দাঁড়াল। বলল, কী ব্যাপার আদিব? তোমার হোমওয়ার্ক আছে না? এই হয়েছে আরেক জ্বালা। নতুন স্কুলে ভর্তি হতে না হতেই আদিব বিরক্ত হয়ে গেছে। নতুন স্কুলে এত্ত হোমওয়ার্ক, এত্ত পড়া! আদিবের আগের স্কুলটা খুব ভাল ছিল। টিচাররা হোমওয়ার্ক কম কম দিতেন। আর স্কুলটা খুব সুন্দর ছিল। সেখানে ফুলের গাছ ছিল, ফলের গাছ ছিল, একটা বড় মাঠ ছিল। টিফিন ব্রেকে ওরা সবাই সেই মাঠে একসঙ্গে খেলত। আদিব সেই কথাগুলো মনে করে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বরিশালে আদিবের স্কুলটার কাছেই নদী ছিল। কূলকূল বয়ে চলা সুন্দর একটা নদী। তার নামটাও খুব সুন্দর। সন্ধ্যা নদী! সেই নদীতে ওরা সবাই একসঙ্গে গোসল করত। ইশ! কত্ত সুন্দর ছিল দিনগুলো! আব্বু আর আম্মুকে দেখে মনে হচ্ছে যে কোন সময় তাদের চোখ দিয়ে আগুন বেরুতে শুরু করবে। আব্বুর হাতে আদিবের রেজাল্ট কার্ড। আব্বু সেটা যে কোন সময় ছিঁড়ে ফেলবে মনে হচ্ছে। রাগে তার হাত কাঁপছে। কড়া গলায় আব্বু জিজ্ঞেস করল, এটা কী আদিব? এটা তোমার রেজাল্ট কার্ড? ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের রেজাল্ট কার্ড এটা? ঢাকায় এসে মানুষের উন্নতি হয়। তোমার এমন অধঃপতন! আদিব মাথা নিচু করে বসে রইল। কিছু বলতে পারল না। আম্মু বলল, তোমার স্কুল থেকে আমাদের ডেকে পাঠাল তোমার বাজে রেজাল্টের জন্য! এই দিনটাও দেখতে হলো আমার! ছিঃ আদিব! তোমার মিস দেখালেন তো আমাকে, তুমি কোন ক্লাসওয়ার্ক ঠিকমতো কর না। হোমওয়ার্ক ঠিকমতো কর না। কেন? তুমি তো এমন ছিলে না! আব্বু বলল, কীসের অভাব তোমার? ক্লাস ফোরে পড় মাত্র, তাও তিনটা কোচিং-এ দিয়েছি। তারপরেও রেজাল্টের এই অবস্থা? আম্মু গজগজ করতে করতে বলল, স্কুল শেষ হতে না হতে তোমাকে নিয়ে কোচিং-এ দৌড়াই। আমার জীবন তেজপাতা হয়ে গেল তোমার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে। তার প্রতিদান এই? আদিব ভয়ে ভয়ে নিচুস্বরে বলল, এই স্কুল আমার ভাল লাগে না। এখানকার পড়াশোনা আমার একটুও ভাল লাগে না। আব্বু অবাক হয়ে বলল, কী বললে তুমি? এই স্কুলের পড়াশোনা তোমার ভাল লাগে না? এটা দেশের সেরা স্কুলগুলোর মধ্যে একটা, তুমি জান? আদিব মাথা নিচু করে বলল, আমার সেরা স্কুল চাই না আব্বু। তুমি আমাকে আমার আগের স্কুলে ভর্তি করে দাও। আমি আবার ভাল রেজাল্ট করব। আম্মু জিজ্ঞেস করল, কী আছে তোমার আগের স্কুলে, যেটা এখানে নেই? অনেকক্ষণ পর যেন আদিবের চোখমুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, আমার আগের স্কুলে অনেক বড় মাঠ আছে আম্মু! সেখানে আমরা একসঙ্গে খেলতাম! এই স্কুলে কোন মাঠ নেই! জান আম্মু, এই স্কুলের জানালা দিয়ে শুধু রাস্তা দেখা যায়, আর গাড়ির আওয়াজ আসে। কিন্তু আমার আগের স্কুলের জানালা দিয়ে গাছ দেখা যেত। পাখির কিচিরমিচির শোনা যেত। আব্বু ধমক দিয়ে বলল, তুমি এখন গাছপালা আর মাঠের জন্য বরিশাল যেতে চাচ্ছ? গাছপালা, মাঠ দিয়ে কী হবে হ্যাঁ? সারাদিন পাখির ডাক শুনলে, গাছের দিকে তাকিয়ে থাকলে আর মাঠে খেললে কি আইনস্টাইন হবে, না নিউটন? কী করবে জীবনে? আদিব বলল, কিন্তু আব্বু, মাঠ যদি না থাকত, গাছ যদি না থাকত, কেউ যদি মাঠে না যেত, গাছের দিকে না তাকাত, তাহলে তো নিউটন গাছতলায় বসতেন না। উনার মাথায় আপেলটাও পড়ত না! আর উনি নিউটনও হতেন না! আব্বু এক মুহূর্তের জন্য চোখ গরম করে আদিবের দিকে তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। কিছু বলল না। আম্মুও একদম চুপ হয়ে গেল। আদিব মাথা নিচু করে রইল। আব্বু কি তাকে বকা দেবে? সে কি একটা বকা খাওয়ার মতো কথা বলে ফেলল? আব্বু হাত ইশারা করে বলল, এদিকে এসো। আদিব ভয়ে ভয়ে তার কাছে এসে দাঁড়াল। আব্বু বলল, আগামী মাসে তুমি আর তোমার আম্মু বরিশালে যাবে। আমি প্রতি বৃহস্পতিবার গিয়ে তোমাদের দেখে আসব। তুমি তোমার আগের স্কুলে ভর্তি হবে আবার। আদিব লাফিয়ে উঠল। হাততালি দিয়ে বলল, সত্যি? আব্বু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, সত্যি। তবে একটা শর্ত আছে। আদিব জিজ্ঞেস করল, কী শর্ত আব্বু? আমাকে ফার্স্ট হতে হবে? আমি হবো ফার্স্ট, তুমি দেখ! আব্বু তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, না। শর্তটা হচ্ছে, তুমি নিউটন হবে না, তুমি আদিব হবে। আমাদের আদিব! আব্বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল আদিব। তার চোখের পানিতে যেন মিশে গেল সন্ধ্যা নদীর শান্ত ধারা। ভিকারুননিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, একাদশ শ্রেণী (ইংলিশ ভার্সন) অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×