ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিদায়ী অর্থবছরে রেকর্ড ৬১০ কোটি ডলার ছাড় সক্ষমতা বাড়ায় দাতারা বেশি অর্থ ছাড় করছে

আস্থা ফিরেছে উন্নয়ন সহযোগীদের ॥ মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে পূর্ণ গতিতে

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৪ জুলাই ২০১৮

 আস্থা ফিরেছে উন্নয়ন সহযোগীদের ॥ মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে  পূর্ণ গতিতে

আনোয়ার রোজেন ॥ কয়েক বছর আগেও চিত্রটা ছিল বিপরীত। কথিত দুর্নীতির অভিযোগে স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। গুলশানে জঙ্গী হামলায় জাপানের সাত নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনায় মুখ থুবড়ে পড়েছিল মেট্রোরেল, মাতারবাড়ি বন্দর ও কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের মতো মেগা প্রকল্পগুলো। তবে বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পড়েনি, বরং ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মাথা তুলেছে পদ্মা সেতু, দৃশ্যমান হয়েছে মেট্রোরেল, এগিয়ে যাচ্ছে মাতারবাড়ি। নিজের সামর্থ্য ও আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে বর্তমান সরকার ফিরিয়ে এনেছে উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থা। সেই আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সাম্প্রতিক তথ্যে। আর সেটি হলো, বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুত ঋণছাড়ে নতুন রেকর্ড হয়েছে। সদ্য বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে বিদেশীদের প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়। আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে গত অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রাথমিক হিসেবে ৬১০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতি ডলার ৮০ টাকা ধরলে স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ হয় প্রায় ৪৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চূড়ান্ত হিসেবে বাংলাদেশ ঋণ সহায়তা পেয়েছিল ৩৫৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ২৫৪ কোটি ডলার বেশি অর্থ সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ, শতাংশের হিসাবে অর্থছাড় বাড়ার এই হার প্রায় ৭২ শতাংশ। জানতে চাইলে ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযম জনকণ্ঠকে বলেন, গত অর্থবছরের পুরো সময়ে বৈদেশিক অর্থছাড়ের লক্ষ্য ছিল ৬৩১ কোটি ১০ লাখ ডলার। প্রাথমিক হিসেবে ইতোমধ্যে ৬০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থছাড় হয়েছে। অর্থবছরের শেষ দিকে কর্ণফুলী টানেল ও পদ্মা রেলসেতু সংযোগসহ বেশ কয়েকটি প্রকল্পে সংশ্লিষ্ট সহযোগীদের অর্থছাড় হয়েছে। তাই চূড়ান্ত হিসেবে অর্থছাড় লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। অর্থছাড় বাড়ার কারণ সম্পর্কে শফিকুল আযম বলেন, বর্তমান সরকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের দ্রুত গতি অর্থছাড় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। বিদেশী অর্থছাড়ের এই গতি চলতি অর্থবছরেও অব্যাহত থাকার প্রত্যাশা রয়েছে। চলতি অর্থবছর সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৭৫০ কোটি ডলার ছাড়ের টার্গেট ঠিক করেছে। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, অর্থছাড় বাড়া বা কমে যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে বিদেশী সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নের গতির ওপর। সময়মতো বাস্তবায়ন হলে সামগ্রিকভাবে অর্থছাড়ের পরিমাণও বাড়ে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি ছাড় করা সম্ভব হয়। এর আগে বাংলাদেশ একক অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২০০ কোটি ডলার পর্যন্ত ছাড় করতে পারত। পরবর্তী তিন বছরে অর্থছাড়ের পরিমাণ বাড়লেও তা ৩০০ কোটির ঘরের ঘোরাফেরা করছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছাড় হয় ৩০৪ কোটি ডলার। পরের দুই অর্থবছরে ছাড় হয় যথাক্রমে ৩৪৫ কোটি ডলার ও ৩৫৬ কোটি ডলার। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এক লাফে ছাড়ের পরিমাণ বেড়ে ৬১০ কোটি ডলার হয়। গত ১০ বছর উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থছাড়ের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে তিনগুণ। ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতার অভাব বিদেশী অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। দক্ষতার সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারলে আগামীতে অর্থছাড়ের পরিমাণ আরও বাড়বে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমরা অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। দেশে উন্নয়নের এক ধরনের জোয়ার তৈরি হয়েছে। আর এতে সন্তুষ্ট হয়ে ডোনাররা এখন বেশি অর্থ ছাড় করছে। একইসঙ্গে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ, যা পাইপলাইনে রয়েছে, ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। একই বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে আমাদের কমিটমেন্ট ও সামর্থ্যরে বিষয়ে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। মাঝখানে হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির কারণে একটি বছর মেগা প্রজেক্টগুলোতে স্থবিরতা এসেছিল। এই সময়ে আমরা বিদেশীদের আশ্বস্ত করেছি। ফলে তারা ফিরে এসেছেন। মেগাপ্রকল্পের কাজ পূর্ণগতিতে এগিয়ে চলেছে। অর্থছাড় সামনের বছর আরও বাড়বে। ইআরডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত অর্থবছরের মে পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা। দাতা সংস্থাটি ছাড় করেছে ১৩২ কোটি ৮২ লাখ ডলার। এ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক ১০৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, রূপপুর প্রকল্পের বিপরীতে রাশিয়া ১০০ কোটি ডলার, পদ্মা রেল সেতু প্রকল্পে চীন ৫৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার এবং এডিবি ছাড় করেছে ৭৭ কোটি ২১ লাখ ডলার। অর্থছাড়ের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি আদায়েও সাফল্য দেখিয়েছে ইআরডি। বিদায়ী অর্থবছরে তাদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ প্রতিশ্রুতি আদায় হয়েছে। ৬০০ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার। এর মধ্যে যমুনায় রেলসেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল ও মাতারবাড়িসহ ছয় প্রকল্পে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাইকা। বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় বাংলাদেশকে একসঙ্গে দেয়া এই প্রতিশ্রুতি জাইকার এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। সবমিলিয়ে অর্থবছর শেষে পাইপলাইনে উন্নয়ন সহযোগীদের ক্রমপুঞ্জীভূত প্রতিশ্রুতির মোট পরিমাণ ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার ৪৫১ কোটি ডলার হয়েছে। অর্থবছরের শুরুতে এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫৭৫ কোটি ডলার। বিদ্যুত, রেল, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন প্রকল্পে রাশিয়া (১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার) , চীন (৪৩৫ কোটি ডলার) ও ভারতের (তৃতীয় এলওসির ৪৫০ কোটি ডলার) ঋণ প্রতিশ্রুতি ক্রমপুঞ্জীভূত প্রতিশ্রুতির পরিমাণ বাড়িয়েছে। ইআরডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১০-১১ থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত পাঁচবছর বাংলাদেশ গড়ে প্রতিবছরে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এর আগে এই প্রতিশ্রুতি ২০০ কোটি ডলারের আশপাশে সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ প্রতিশ্রুতি ৭০০ কোটি ডলার স্পর্শ করে। গত তিন বছরে এই প্রতিশ্রুতি বেড়ে পুঞ্জীভূত প্রতিশ্রুতির আকারও বেড়েছে। এটা সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ওপর বিদেশীদের আস্থার প্রতিফলন। সম্প্রতি দুই দিনের বাংলাদেশ সফরে আসা বিশ^ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক উন্নতির প্রশংসা করে বলেছেন, দারিদ্র্য নিরসন ও সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টিতে বাংলাদেশ ‘বিশ্ব নেতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নতি অন্যান্য দেশের জন্য অনুপ্রেরণার। জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরি জনকণ্ঠকে বলেন, এটা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতি বিদেশীদের আস্থার প্রতিফলন। রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়ার দেয়া বিশাল অঙ্কের ঋণের সুদাসল প্রথম ১০ বছর পরিশোধ করতে হবে না (গ্রেস পিরিয়ড)। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা শুরু হবে ২০২৭ সালের মার্চ থেকে। এই সময়ের মধ্যে রাশিয়ার কাছ থেকে প্রতিশ্রুত অর্থের নির্দিষ্ট অংশের সবটুকু যাতে আদায় ও ব্যবহার করা যায়, সেক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ।
×