ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রানী সরকার বঙ্গের বর্গী থেকে খাঁচা

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ১২ জুলাই ২০১৮

রানী সরকার বঙ্গের বর্গী থেকে খাঁচা

তাঁর সঙ্গে সবশেষ দেখা হয়েছিল মাস ছয়েক আগে একটি সিনেমার মহরত এবং জন্মদিনের আনুষ্ঠানে। রুগ্ন স্বাস্থ্য, সাধারণ শাড়িতে দেখে প্রথমে চিনতেই পারিনি, এই কি সেই! যাকে সেই ছোট বেলা থেকে দেখে আসেছি, টিভি পর্দায় এবং সিনেমায়। যার নামের পাশে শত শত সিনেমার নাম। বাড়ির অন্দোরমহল থেকে সিনেগসিবে, যার নাম বহুসময় উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তিনি রানী সরকার। ৮৬ বছর বয়সে গত হয়েছে। গত ৭ জুলাই ঢাকার ইডেন মাল্টি কেয়ার হাসপাতালে। দীর্ঘ ষাট বছর ধরে অভিনয় শিল্পে নিজের প্রেম ঢেলে দিয়েছেন। যার প্রতিক্রিয়া চরমভাবে দর্শকমহলে আলোড়িত করেছে। উদাহরণ হিসেবে একটা স্মৃতিকথা বলি। সেদিন ছিল শুক্রবার। সময় ১৯৯৬ সাল। বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রতি শুক্রবার দুপুরের কিছু পরে পূণ্যদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি দেখায়। ’৯৬ সালে বাংলার ঘরে ঘরে তখন টেলিভিশন পৌঁছায়নি। শহরতলিতে অল্পবিস্তার থাকলেও গ্রামের দৃশ্যপট একেবারেই ভিন্ন। সে সময় গ্রামের যে বাড়িতে টেলিভিশন ছিল, দুপুরের পর ওই বাড়ির উঠানে আশপাশের ছেলে ছোকড়া থেকে বয়স্ক মুরব্বি ভিড় জমাতে থাকে, কোন কোন দিন ঘরের বাইরে টেবিল পেতে আগত সকলের জন্য সিনেমা দেখার ব্যবস্থা করা হতো। বিশেষ করে নায়ক রাজ্জাক-শাবানা, কবরী কিংবা ববিতার সিনেমা হলে তো আর কথাই নেই। বাড়ি ভর্তি মানুষ তখন সিনেমা শুরুর অপেক্ষায়। আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিতে এমন অনেক দৃশ্য আজও জল জল করে। সেদিন শুক্রবার শীতের বিকেলে টেলিভিশনে পর্দায় ঘোষণা এলো কিছুক্ষণ পর প্রচারিত হবে ‘নাচের পুতুল’। শ্রেষ্ঠাংশে রাজ্জাক, শবনম, রানী সরকার। উপস্থিত সকলে যখন এই নামগুলো শুনছিল তখন আনন্দ আর উত্তেজনায় নিজেদের মধ্যে অভিনয় শিল্পীদের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে গল্প শুরু করে। পরিষ্কার মনে আছে যখন রানী সরকারের নাম এলো তখন উপস্থিত কয়েকজন বলতে শুরু করল ওরে বাবা ওই ‘কুট বেটি’ খবর আছে রাজ্জাকের! আজ বুঝি কি গভীর প্রভাব ছিল বাংলা সিনেমার, আমাদের আবহমান জীবনে। একই সঙ্গে রানী সরকারের। সেই থেকে আমার মস্তিষ্ক তাঁর নাম শক্তভাবে গেঁথে যায়। দেখে ফেলি ‘নাচের পুতুল’। উপস্থিত সকলের সঙ্গে তাঁর অভিনয় দেখে উত্তেজিত হয়ে নিজেও উষ্মা ছড়িয়েছি। শেষে নীনা (রানী সরকার) চরিত্রের পতনে ভীষণ খুশি হয়ে আর একটা শুক্রবারের অপেক্ষায় থেকেছি আপামোড় সিনেমাপ্রেমীর দলে। আজও মনে আছে সেসব স্মৃতি। রানী সরকার ছিলেন ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে খুবই সুপরিচিত একজন নেতিবাচক চরিত্রের শাক্তিশালী অভিনেত্রী। ১৯৫৮ সালে মঞ্চ নাটক ‘বঙ্গের বর্গী’র মধ্যদিয়ে দর্শকদের সামনে আসেন, সেই রক্ষণশীল যুগে। সময়টা কিন্তু ষাট বছর আগের কথা। ভাবতে একটু জিরোতেই হয়। একই বছর রীনা সরকার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় এ জে কারদার পরিচালিত ‘দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও’ এর পর একে একে করেন উর্দু চলচ্চিত্র ‘চান্দা’ ‘তালাশ’ এরপর বাংলা ছবি ‘নতুন সুর’- কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করেন রানী সরকার। প্রায় হাজার খানেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই অভিনেত্রী। কাঁচের দেয়াল, বেহুলা, আনোয়ারা, অরুন বরুণ কিরণ মালা, ছদ্মবেশী, নাচের পুতুল এবং রংবাজের মতো বহু দর্শক নন্দিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত শেষ চলচ্চিত্র আকরাম খান পরিচালিত ‘খাঁচা’ মুক্তি পায় ২০১৭ সালে। সে হিসেবে জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত ক্যমেরার সামনে কাজ করেছেন এই অভিনেত্রী। অভিনয় জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জীবন সায়াহ্নে রানী সরকার অর্থিক অনটনের মধ্যে কিছুকাল অতিবাহিত করেছে, কিন্তু যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হয়েছেন তার আর্থিক সুবিধাসহ অনান্য বিষয়গুলো তিনি দায়িত্ব নিয়ে নিশ্চিত করেছেন। এতকিছুর পরেও সব শেষ তাকে যখন দেখেছি মুখে আলোক রশ্মি খুঁজে পাওয়ানি। হয়ত তখনও আর্থিক অসুবিধা নয়ত অন্য কোন অপুণ্যতা তাকে তাড়িত করে চলেছে। সবশেষ একটা মূল্যায়ন করতেই হয় সাহসী নারী রানী সরকারদের পথ ধরেই আমাদের চলচ্চিত্রকাশে সাবানা, কবরী সুচন্দা ববিতা চম্পাদের মতো চৌকস অভিনেত্রীদের আগমন ঘটেছে।
×