ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঋণ আমানতে নতুন সুদ আজ থেকে ॥ প্রথম পর্যায়ে ব্যাংকগুলো শুধু শিল্পঋণে ৯ শতাংশ সুদ নেবে

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২ জুলাই ২০১৮

ঋণ আমানতে নতুন  সুদ আজ থেকে ॥ প্রথম পর্যায়ে ব্যাংকগুলো শুধু শিল্পঋণে ৯ শতাংশ সুদ নেবে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ব্যাংক হলিডের কারণে রবিবার লেনদেন বন্ধ থাকায় ঋণ ও আমানতে ব্যাংকগুলো আজ সোমবার থেকে নতুন সুদহার কার্যকর করবে। প্রথম পর্যায়ে ব্যাংকগুলো শুধু শিল্পঋণে ৯ শতাংশ সুদ নেবে। আর তিন মাস মেয়াদি আমানতে সুদ দেবে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ। পর্যায়ক্রমে অন্য সব ক্ষেত্রে সুদহার কমানো হবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। এদিকে আজ সোমবার গবর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর এমডিদের একটি পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এ বৈঠকে সুদহার কার্যকরের বিষয়টি মূল আলোচ্য হবে বলে জানা গেছে। বৈঠক থেকে ব্যাংকগুলোর এমডিদের বিএবির ঘোষণার আলোকে সুদহার কার্যকরের বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া হবে। দীর্ঘদিন ধরে শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়ে আসছেন। সরকারও চায় ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামুক। এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২০ জুন এক বৈঠক থেকে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় বেসরকারী ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। একই দিন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারী ব্যাংকগুলোর এক বৈঠকেও একই রকম সিদ্ধান্ত হয়। বিএবির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিনিয়োগ বাড়াতে ১ জুলাই থেকে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ এবং ৬ শতাংশ সুদে তিন মাস মেয়াদি আমানত নেয়া হবে। তবে সব ঋণে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামবে কি-না বিএবির বৈঠকে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এরপর গত ২৭ জুন এমডিদের মধ্যে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়- এখনই সব ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামবে না। আবার শুধু তিন মাস মেয়াদি নয়, সব ধরনের আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ নির্ধারণ না করলে আমানত সংগ্রহে অসম প্রতিযোগিতা দেখা দিলে মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে না। তবে এসব সিদ্ধান্ত হবে ব্যাংকগুলোর নিজ পর্ষদে। ফলে ব্যাংকগুলো ঋণ আমানতে কী রকম সুদ ঘোষণা করছে, আজকের পর তা জানা যাবে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) বলছেন, ১ জুলাই থেকে শুধু শিল্প ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামানো সম্ভব হবে। তবে কম সুদে আমানত পেলে পর্যায়ক্রমে অন্য ক্ষেত্রেও সুদহার কমে আসবে। একটি বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, আগামী কয়েক মাসেও সব ঋণে সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে আনা সম্ভব হবে না। কোন কোন ব্যাংক হয়ত শিল্পের মেয়াদি ঋণ, চলতি মূলধন ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে রাখবে। তিনি বলেন, গত এক বছর ধরে যে সব ব্যাংক ১১ শতাংশেরও বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করেছে, সেই সব ব্যাংক ইচ্ছে করলেও সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দিতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএবির ঘোষণা অনুযায়ী সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে আনতে হলে সব ব্যাংকের বোর্ডে সিদ্ধান্ত হতে হবে। কারণ প্রত্যেকটা ব্যাংকের বোর্ড আলাদা। কাজেই স্ব স্ব ব্যাংকের বোর্ড যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই হবে। তিনি বলেন, বোর্ডের সিদ্ধান্ত কোন কোন ব্যাংক কীভাবে বাস্তবায়ন করবে, সেটাও নির্ভর করছে ওই ব্যাংকের ইচ্ছের ওপর। হয়ত কোন ব্যাংক ঘোষণা দিয়েও বাস্তবায়ন করল না, সেটা তো আমরা দেখতে পারব না। তবে বিএবির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমরা অন্তত একটি খাতে হলেও গ্রাহকদের সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দিতে পারব। এবিবির এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সব ঋণে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামাতে গেলে ব্যাংক ব্যবসা ঝুঁকিতে পড়বে। সুদের হার কমাতে গিয়ে ব্যাংকের আয় কমে গেলে সরকারের রাজস্ব খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, সরকারের রাজস্ব আদায়ের বড় ভূমিকা রাখে ব্যাংক খাত। এই ব্যাংক খাতের আয় কমলে সরকারও কম রাজস্ব পাবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার উদ্দেশ্য সৎ হলেও সময় বেঁধে ঘোষণা দেয়া ঠিক না। হঠাৎ করে এক অঙ্কে ঋণের সুদ নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। দুই একটি ব্যাংক কমাতে পারলেও পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্য এটি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। তাই এ সব বিষয়ে ঘোষণা দেয়ার আগে ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সঙ্কট রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক ব্যাংক এ সঙ্কট মেটাতে বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। যেসব ব্যাংক বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে তাদের ক্ষেত্রে কী হবে। এ অবস্থায় ব্যাংকার ও পরিচালকদের ঘোষণা অনুযায়ী ১ জুলাই থেকে সব ব্যাংকের ঋণের সুদ এক অঙ্কে নামিয়ে আনা কঠিন হবে। তিনি বলেন, তারল্য সঙ্কটের বিষয়ে ইতোমধ্যে ব্যাংকাররা বলেছেন। তারা ঋণের সুদহার কমাতে স্বল্প সুদে সরকারী আমানত চেয়েছেন। তাই ব্যাংকগুলোর কম সুদে নতুন আমানত সংগ্রহ করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তা না হলে ঋণ-আমানতের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে। সাবেক এ গবর্নর বলেন, ঋণের সুদহার কমলে বিনিয়োগ বেড়ে যাবে। নতুন করে উদ্যোক্তরা ঋণ চাইবে। তখন ব্যাংকে অর্থ না থাকলে ঋণ দেবে কীভাবে? এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বাড়তি চাপে পড়বে। আগ্রাসী ঋণের আশঙ্কা থাকবে। অনেক জায়গায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই উল্টা-পাল্টা ঋণ চলে যাবে। তাই সতর্ক থাকতে হবে। অর্থাৎ ঋণের সুস্থ ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে পুরো খাতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ চাঙ্গা রাখতে অবশ্যই ১০ শতাংশের নিচে ঋণের সুদহার থাকা ভাল। তবে বিএবির সুদহার নির্ধারণ করে দেয়াটা ঠিক হয়নি। ব্যাংকের সুদহার কত হবে, বাজার ব্যবস্থা তা নির্ধারণ করবে। এটি চাপিয়ে দেয়ার বিষয় না। কোন সংস্থা ইচ্ছেমতো সুদহার নির্ধারণ করলে তা ব্যাংকিং খাতে সুফল আনবে না বরং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে। এটি বাজারের ওপরে ছেড়ে দেয়া উচিত বলে তিনি জানান।
×