ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দাপুটে জয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্স ॥ বিবাহবার্ষিকীতে বিধ্বস্ত মেসি ॥ জোড়া গোল করে নায়ক এমবাপে ॥ ফ্রান্স ৪-৩ আর্জেন্টিনা

মেসিদের বিদায়

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১ জুলাই ২০১৮

মেসিদের বিদায়

জাহিদুল আলম জয় ॥ এক বছর আগে দীর্ঘদিনের প্রেমিকা এ্যান্টোনেল্লা রোকুজ্জোকে বিয়ে করেন সুপারস্টার লিওনেল মেসি। ৩০ জুন ছিল মেসি-রোকুজ্জোর প্রথম বিবাহবার্ষিকী। বার্সিলোনা জাদুকর হয়ত ভেবেছিলেন বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে জিতিয়েই বউকে দেবেন বিয়েবার্ষিকীর উপহার। কিন্তু সেটা আর হলো না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নকআউট পর্বে উঠে আসা আর্জেন্টিনা রাশিয়া বিশ্বকাপের শেষ ষোলো থেকেই বিদায় নিয়েছে। শনিবার মেসির বিবাহবার্ষিকীর রাতে কাজানের কাজান এ্যারানায় ফ্রান্সের কাছে ৪-৩ গোলে হেরেছে দুইবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালের এই ম্যাচে ফরাসীদের হয়ে সৌরভ ছড়ান তরুণ তারকা কিলিয়ান এমবাপে। পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা পিএসজি ফরোয়ার্ড করেন জোড়া গোল। ফ্রান্সের হয়ে বাকি দুই গোল করেন এ্যান্টোনিও গ্রিজম্যান ও বেঞ্জামিন পাভার্ড। আর্জেন্টিনার হয়ে গোল করেন মিডফিল্ডার অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, ডিফেন্ডার মার্কাডো ও ফরোয়ার্ড সার্জিও এ্যাগুয়েরো। এই জয়ে বিশ্বকাপের প্রথম দল হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেছে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা। আর শেষ আটের আগেই বিদায় নিতে হয়েছে ২০১৪ বিশ্বকাপের রানার্সআপদের। সেমিফাইনালের টিকেট পাওয়ার মিশনে ফ্রান্সকে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে হবে উরুগুয়ে ও পর্তুগালের মধ্যকার বিজয়ী দলের বিরুদ্ধে। পুরো ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরপরও একপর্যায়ে এগিয়ে যায় তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চোখের জলেই বিদায় নিতে হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দেশটিকে। আর্জেন্টিনা তিন গোল পেলেও যেন অনেকটা বলে কয়ে মেসিদের বিদায় করে দিয়েছেন এমবাপে, গ্রিজম্যানরা! ফ্রান্সের গতি, দৈহিক সামর্থের কাছে মেসি, মারিয়ারা ছিলেন রীতিমতো অসহায়। অনেক সহজ সুযোগ নষ্ট না করলে আর্জেন্টিনার গোলের মালা হয়ত আরও বেশি হতো। এই ম্যাচেও আর্জেন্টাইন অধিনায়ককে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকে অনেকটাই বোতলবন্দী করে রাখেন ফ্রান্সের সোনালি প্রজন্মের ফুটবলাররা। বাঁচামরার ম্যাচে আরেকবার একাদশ পরিবর্তন করে দল সাজান আর্জেন্টাইন কোচ জর্জ সাম্পাওলি। অর্থাৎ সবশেষ ম্যাচের সেরা একাদশের সঙ্গে এই ম্যাচের একাদশে পরিবর্তন আনা হয়। তবে আর্জেন্টাইন কোচ সার্জিও এ্যাগুয়েরো ও গঞ্জালো হিগুয়াইন দু’জনকেই বাইরে রেখে চমক দেখান। কোচ সাম্পাওলি দলকে খেলান ৪-৩-৩ ফর্মেশনে। প্রাণভোমরা মেসিকে মাঝখানে রেখে। আর্জেন্টিনার সেরা একাদশে খেলেন গোলরক্ষক আরমানি, মার্কাডো, ওটামেন্ডি, রোজো, টাগলিয়াফিকো, পেরেজ, মাশ্চেরানো, বানেগা, পাভন, মেসি ও ডি মারিয়া। অন্যদিকে ফ্রান্স তাদের সেরা একাদশ নিয়েই মাঠে নামে। ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে ফরাসীদের সেরা একাদশে খেলেন গোলরক্ষক হুগো লরিস, পাভার্ড, ভারানে, উমটিটি, হার্নান্দেজ, কান্টে, পোগবা, এমবাপে, গ্রিজম্যান, মাটুইডি ও জিরুড। কাজান এ্যারানায় ফেবারিটের মতোই শুরু করে ফ্রান্স। শুরু থেকেই বল দখলের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকে ফরাসীরা। নবম মিনিটে এগিয়ে যাওয়ার নিশ্চিত সুযোগ হাতছাড়া করে দিদিয়ের দেশমের দল। ২৫ গজ দূর থেকে এ্যান্টোনিও গ্রিজম্যানের নেয়া দুর্দান্ত ফ্রিকিক বারপোস্টে লেগে প্রতিহত হয়। কিলিয়ান এমবাপেকে আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার জ্যাভিয়ের মাশ্চেরানো ফাউল করলে ফ্রিকিক পায় ফ্রান্স। ১১ মিনিটে এমবাপে মাঝমাঠ থেকে একক প্রচেষ্টায় বল নিয়ে আর্জেন্টিনার ডি বক্সের ঢুকে পড়েন। কিন্তু তাঁকে ডি বক্সের মধ্যে দুইবার হাত দিয়ে টেনে ফেলে দেন মার্কোস রোজো। ফলে ফ্রান্স পেনাল্টি পাওয়ার পাশাপাশি হলুদ কার্ড দেখেন রোজো। ১৩ মিনিটে বাম পায়ে দারুণ শটে গোল করে ফ্রান্সকে এগিয়ে দেন গ্রিজম্যান (১-০)। ম্যাচের ১৯ মিনিটে আবারও ভাল সুযোগ পায় ফ্রান্স। মাঝমাঠ থেকে উড়ে আসা বল দারুণ দক্ষতায় রিসিভ করেন পুরো ম্যাচে অসাধারণ খেলা এমবাপে। কিন্তু তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে হলুদ কার্ড দেখেন আর্জেন্টিনার টাগলিয়াফিকো। এরপর ২১ মিনিটে ডি বক্সের মাথা থেকে পল পোগবার ফ্রিকিক বারপোস্ট উঁচিয়ে বাইরে যায়। ২৬ মিনিটে আরেকটি ভাল সুযোগ হাতছাড়া হয় ফরাসীদের। ২৮ মিনিটে ম্যাচে প্রথমবার ভাল সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। পাভনের বাড়ানো ক্রসে মাকার্ডের শট সাইডপোস্ট ঘেষে বাইরে যায়। ৩৯ মিনিটে আরও একবার মেসিদের রক্ষণভাগ কাঁপিয়ে দেন ফরাসী ফুটবলাররা। কিন্তু সহজ সুযোগ নষ্ট করেন পাভার্ড। এরপর ম্যাচে আচমকাই সমতা ফেরায় আর্জেন্টিনা। ৪১ মিনিটে আচমকা দূরপাল্লার শটে লক্ষ্যভেদ করেন মিডফিল্ডার এ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া (১-১)। ডি বক্সের অনেকটা বাইরে এভার বানেগার কাছ থেকে একটু ফাঁকায় বল পান তিনি। দেখেশুনে প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে বাঁ পায়ের দুর্দান্ত বাঁকানো শটে বল জালে পাঠান ডান পোস্ট ঘেঁষে। ঝাঁপিয়েও বলের নাগাল পাননি ফরাসী গোলরক্ষক হুগো লরিস। এবারের আসরে এখন পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে দূর থেকে গোল। ১-১ সমতাবস্থায় শেষ হয় প্রথমার্ধের খেলা। এই অর্ধে ফরাসীদের দাপট ছিল দেখার মতো। আর্জেন্টিনার সেরা তারকা মেসি প্রায় পুরোটা সময়ই ছিলেন নিষ্প্রভ। বিরতির পর ম্যাচ জমিয়ে তোলে আর্জেন্টিনা। ৪৮ মিনিটে মাকার্ডোর আচমকা গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। ডানপ্রান্ত থেকে মেসি বল বাড়ান ডি বক্সে। চলতি বলে পা লাগিয়ে গোল করেন মার্কাডো (১-২)। এই গোল হজম করার পর হতভম্ব হয়ে যায় ফরাসী শিবির। পিছিয়ে পড়ে আরও তেতে ওঠেন দলটির তারকা ফুটবলাররা। ফলশ্রুতিতে ৫৮ মিনিটে সমতা ফেরায় ১৯৯৮ সালের চ্যাম্পিয়নরা। সংঘবদ্ধ আক্রমণে ডি বক্সের বাইরে থেকে চলতি বলে আচমকা শটে লক্ষ্যভেদ করেন পাভার্ড (২-২)। সমতা ফেরানোর পর ফ্রান্সের আক্রমণের ঢেউয়ে রীতিমতো অসহায় আত্মসমর্পণ করে আর্জেন্টিনা। একের পর এক আক্রমণ করে পরবর্তী দশ মিনিটে আরও দুই গোল আদায় করে নেয় তারা। ফলে জয়ও প্রায় নিশ্চিত করে ফেলে। পুরো ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে যেন একাই নাকাল করে দেন এমবাপে। আগে বেশ কয়েকবার গোলবঞ্চিত হলেও চার মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল করে ফ্রান্সকে চালকের আসনে পৌঁছে দেন তারকা এই ফরোয়ার্ড। ৬৪ মিনিটে পরিকল্পিত আক্রমণ থেকে বা পায়ের দৃষ্টিনন্দন শটে গোল করেন এমবাপে (৩-২)। ৬৪ মিনিটে চার নম্বর গোল পায় ফ্রান্স। আর এমবাপে পান দ্বিতীয় গোল। এবার নিজেদের অর্ধে গোলরক্ষকের কাছ থেকে বল পেয়ে একে একে আর্জেন্টিনার ফুটবলারদের ডজ দিয়ে এগিয়ে যান ফরাসী যুবারা। দুর্দান্ত পরিকল্পনার স্বাক্ষর রেখে অসাধারণ শটে লক্ষ্যভেদ করেন ফরাসী জায়ান্ট পিএসজিতে খেলা এমবাপে (৪-২)। স্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার পরও আক্রমণের ধার কমায়নি ফ্রান্স। আরও কয়েকটি সুযোগ নষ্ট না হলে আর্জেন্টিনার লজ্জার মালা আরও বড় হতে পারত। ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে (৯৩ মিনিট) বদলি সার্জিও এ্যাগুয়েরো হেডে গোল করে আর্জেন্টিনার পরাজয়ের ব্যবধানই শুধু কমান (৪-৩)।
×