গাফফার খান চৌধুরী/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/ নুরুল ইসলাম, গাজীপুর থেকে ॥ অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এবার আর ভুল করতে চান না গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোটাররা। তারা সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশীদার হতে চান। উন্নয়নে লাভবান হতেই এবার তারা সঠিক জায়গায় ভোট দিতে আগ্রহী। যার মাথায় ছাতা নেই, তাকে ভোট দিয়ে কোন লাভ নেই। সেটি অতীতে প্রমাণিত হয়েছে।
ভোটাররা সরকারকে বিশাল চমক দেখানোর চেষ্টা করছেন। সেজন্য তারা নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যেই কাকে ভোট দিলে লাভ হবে, তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যেও সেই অনুপাতে বাড়তি উত্তেজনা বাড়ছে। এদিকে গোপনে জামায়াত-শিবির ও জঙ্গীরা বিভিন্ন প্রার্থীর লোক সেজে কাজ করছে। তবে তারা কোন নাশকতা করতে পারবে না বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে বলা হচ্ছে। আর ভোটাররা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিবেন।
শুক্রবার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কোণাবাড়ি, বোর্ডবাজার, জয়দেবপুর, হরিণহাটিসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে এমন চিত্র। কোণাবাড়ির হরিণহাটা গ্রামের মুদি দোকানি সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ভোটের বিষয়ে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই তিনি ও তার স্ত্রী বলছিলেন, আমরা এত কিছু বুঝি না। আমরা তেমন শিক্ষিত নই। তাই মারপ্যাঁচ বুঝি না। শুধু এ টুকু বুঝি, যাকে ভোট দিলে লাভ হবে, তাকেই ভোট দিব। সরকার দেশের উন্নয়ন করছে। আমরা সেই উন্নয়নের সুফল পাচ্ছি। দোকানের সামনে এক সময় বৃষ্টি হলে ৪ ফুট পানি জমতো। সরকার ড্রেন করে দিয়েছে। তার সুফল পাচ্ছি। সরকার যাতে আরও উন্নয়ন করতে পারে, এজন্য আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। যার মাথায় ছাতা নেই, তাকে ভোট দিয়ে কি লাভ!
এই দম্পতি অধ্যাপক আব্দুল মান্নানের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, তিনি তো কোন কাজ করেননি। তাদের দলের যিনি নির্বাচন করছেন, তিনিও কাজ করবেন না। তাই আমরা আর অতীতের মতো ভুল করতে চাই না। সরকার আমাদের কি চমক দেখাবে? আমরাই সরকারকে চমক দেখাবো আগামী ২৬ জুন।
হরিণহাটির আরও অনেকের সঙ্গেই কথা বলে মিলেছে এমন তথ্য। তারা জানান, আগামী পাঁচ বছর আওয়ামী সরকারের ক্ষমতা থাকা দরকার। তাহলে আরও উন্নয়ন হবে। সরকার যেভাবে কাজ করছে, তাতে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতে যাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দিলে লাভ হবে। অন্য কাউকে দিলে কোন লাভ হবে না। তাই তারা নিজেরাই নিজ উদ্যোগে কাকে ভোট দিতে হবে, সে বিষয়ে আলাপ আলোচনা সেরে নিচ্ছি। প্রার্থীর ভোটারদের ঘরে ঘরে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। নিজেদের স্বার্থেই সরকারের হাতকে শক্তিশালী করতে হবে।
অটোচালক রমজান শেখ বলছিলেন, হাসান উদ্দিন সরকার টঙ্গী কেন্দ্রিক কিছুটা উন্নয়ন করেছেন। পুরো সিটিতে করেননি। এছাড়া তিনি ঘন ঘন দল পরিবর্তন করেন। যারা দল পরিবর্তন করেন, তারা ভাল লোক তা ভাবার কোন সুযোগ নেই। এ ধরনের লোক সুযোগসন্ধানী হয়। আর জাহাঙ্গীর আলম বিগত তিন বছর ধরে নির্বাচনের জন্য কাজ করছেন। তিনি জাহাঙ্গীর আলম শিক্ষা ফাউন্ডেশন নামে একটি সমিতি গঠন করেছেন। সেই সমিটিতে বেকার প্রায় তিন শ’ বয়স্ক ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তারা বিভিন্ন স্কুল কলেজে গিয়ে নানা প্রয়োজনীয় কাজ, মসজিদে মসজিদে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিতরণ, রোজার সময় ক্যালেন্ডার সরবরাহ করেছেন। সবচেয়ে বড় কাজ করেছেন, রাস্তায় যানজটে এক সময় গাজীপুরবাসী নাকাল ছিল। তার লোকজন গত কয়েক বছর ধরে পুলিশের সঙ্গে রাস্তায় থেকে যানজট নিরসনে কাজ করছেন। যা গাজীপুরবাসীর জন্য খুবই খুুশির খবর। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের বিষয়ে গত দুই দিনে অন্তত শতাধিক ভোটারের সঙ্গে কথা বলেও মিলেছে এমন চিত্র।
স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, গাজীপুর গার্মেন্টসসহ অন্যান্য কলকারখানা মিলিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। তাই এ জায়গায় এমন কাউকে মেয়র নির্বাচন করা যাবে না, যিনি সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-কে ব্যাহত করতে পারে। কারণ সরকার বিরোধী কোন লোক যদি মেয়র হন, তিনি ইচ্ছে করলেই মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিসে গাজীপুরে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি করা সম্ভব। এতে করে দেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আসার পথ বন্ধ হবে। দেশের ভাবমূর্তি বিদেশে চরমভাবে ক্ষুন্ন হবে। এছাড়া লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের বিষয়টি তো থাকছেই। তাই সবমিলিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-কে গতিশীল রাখতে উচিত সঠিক জায়গায় ভোট প্রয়োগ করা। এ ব্যাপারে তারা তাদের অধীনে কর্মরত ভোটারদেরও বিষয়টি খুলে বলেছেন।
এদিকে শুক্রবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের মনোনীত প্রার্থী (নৌকা প্রতীক) এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম প্রচার চালিয়েছেন। চান্দনা চৌরাস্তা জামে মসজিদে পবিত্র জুমার নামাজ আদায় শেষে তিনি মসজিদ আঙিনায় মুসল্লিদের কাছে দোয়া ও ভোট কামনা করেন। এছাড়া তিনি মহানগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে পথসভা করেন। তাতে উপস্থিত ছিলেন শত শত মানুষ। প্রচার অংশ নেন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা তালুকদার আব্দুল খালেক, ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, ওলামা লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আখতার হোসেন বোখারী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সবুরসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাতী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, মহাজোট শরিক জাতীয় পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশনসহ সকল অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।
অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বিএনপির কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খোন্দকার মোশারফ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ ফজলুল হক মিলনসহ উর্ধতন নেতাদের নিয়ে ভোটারদের কাছে গিয়ে ধানের শীষ মার্কায় ভোট চান। ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেছেন, জনগণ ভোট দিতে পারলে বিশাল ভোটের ব্যবধানে আমাদের প্রার্থী বিজয়ী হবে। হাসান উদ্দিন সরকার বিভিন্ন জায়গায় পথসভাও করেন।
জেলা নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৬ জুন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। আগামী ২৪ জুন দিবাগত রাতে সব ধরনের প্রচারণা শেষ হচ্ছে। মোট ৫৭টি ওয়ার্ড নিয়ে সিটি কর্পোরেশন গঠিত। ভোটারের সংখ্যা ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৬ জন। পুরুষ ও নারী ভোটারের সংখ্যা প্রায় সমান সমান। ভোটকেন্দ্র ৪২৫টি। ৩৩৭টি গুরুত্বপূর্ণ। বাকি ৮৮টি সাধারণ।
গাজীপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল শেখ জনকণ্ঠকে জানান, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করতে কড়া নির্দেশ দিয়েছে। নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ করার জন্য কাজ করছি। জামায়াত-শিবির-জঙ্গীরা বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের লোক সেজে কাজ করার বিষয়ে তাদের কাছে প্রাথমিক তথ্য আছে। সে মোতাবেক গোয়েন্দা নজরদারি ও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। প্রার্থীদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। অনেকের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তবে নাশকতার কোন আশঙ্কা নেই।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: