ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রফতানি বাণিজ্যে আম

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ১০ জুন ২০১৮

রফতানি বাণিজ্যে আম

রাজকীয় ফল আম পুষ্টিগুণের পাশাপাশি লাভজনক অর্থকরী ফসল হিসাবেও জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। আম আমাদের জাতীয় ফল না হলেও আমের জনপ্রিয়তা ফলের মধ্যে শীর্ষে। পৃথিবীতে আম উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সফতম। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলোতে আমের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আমের চাষ বেড়েছে অনেকগুণ। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই আমের ফলন হলেও রাজশাহীর আমের আছে অনেক সুনাম। আনন্দের সংবাদ হলো- বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আমের নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন বিশ্ববাজারে রফতানি তালিকায় নতুন যুক্ত হওয়া বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্য আম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে নতুন আশার পথ উন্মোচন করেছে। তথ্য-উপাত্তে জানাগেছে- দেশে বর্তমানে প্রায় দেড় কোটি আম গাছ রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতিবছর নতুন করে আট হাজার হেক্টর জমি আম চাষের আওতায় আসছে। ফলে বছর প্রতি আম উৎপাদন বাড়ছে ৫০ হাজার টন। সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি ফ্রুট ব্যাগিং করা আম স্বাদ ও গুণে থাকছে অটুট। তাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের এ আম এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে সুদূর ইউরোপের দেশগুলোতে। ফলে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতি এ অঞ্চলের আমচাষীদের জন্য অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ পদ্ধতির নতুন ধারণা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে অভিনব এ পদ্ধতির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয় ২০১৫ সালে। যার আকাশচুম্বী সফলতা আসে মাত্র এক বছরেই। এরপর থেকে নতুন পদ্ধতিতে বাড়ছে আমচাষ। আম বাগানে সারি সারি গাছে ঝুলছে চীন থেকে আসা হলুদ রঙের বিশেষায়িত ব্যাগের ভেতরে আদর-যতেœ ঢেকে রাখা আম। জানা গেছে, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ ২০ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উৎপাদিত হচ্ছে। নিরাপদ বিষমুক্ত ও রফতানিযোগ্য আম উৎপাদিত হওয়ায় ইতোমধ্যে এ পদ্ধতি বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফ্রুট ড্রিংকস ও জুস এর অর্থনীতি আম ফলের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে জুস শিল্প। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমের জুস এখন রফতানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বর্তমানে দেশ ও রফতানি মিলে জুসের বাজার দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার। দেশে ফল প্রক্রিয়াজাত শিল্পের পথিকৃৎ হিসেবে বলা যায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কথা। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৩ সালে ফ্রুট ড্রিংকস ও জুস উৎপাদন এবং বাজারজাত করা শুরু করে। জুসের বাজারে প্রাণ-আরএফএল, আকিজ, একমি, সজীব, ট্রান্সকম ও পারটেক্স গ্রুপ এগিয়ে আছে। জুসের বাজারে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ব্র্যান্ড ফ্রুটো, আকিজের ফ্রুটিকা, একমি গ্রুপের একমি, সজীব গ্রুপের সেজান, ট্রান্সকমের স্লাইস ও পারটেক্স গ্রুপের ড্যানিশ প্রভৃতি। বাংলাদেশের জুস রফতানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ আরব আমিরাত, আবুধাবি, দুবাই, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান ছাড়াও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইতালি, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের বাজারে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপারটি হচ্ছে দেশে উৎপাদিত এবং বাজারজাতকৃত জুস ও ফ্রুট ড্রিংকসে মেশানো হচ্ছে ভেজাল। ভেজাল মিশ্রিত, নিম্নমানের এবং মাত্রাতিরিক্ত এসিটিক এসিড থাকায় এগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। ১৭ অক্টোবর ২০১৭ বুয়েটের রাসায়নিক পরীক্ষায় প্রমাণ মিলেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে আম অর্থনৈতিক দিক থেকে আমের অবদান কোন অংশে কম নয়। বাংলাদেশ আম উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী সমিতির হিসাবে, দেশে বর্তমানে আমের অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার। জানলে অবাক হতে হয়, শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে কেন্দ্র করে বছরে দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। বছরে কেবল চাঁপাইনবাবগঞ্জেই বিক্রি হচ্ছে প্রায় ছয় কোটি টাকার দুই লাখ আমের চারা। আমবাগান বৃদ্ধির পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত কর্মজীবীর সংখ্যাও বাড়ছে। আমের মৌসুমে এখানে ৮ থেকে ১০ লাখ লোক আম গাছ পরিচর্যা, বাগান পরিষ্কার রাখা, আম সংগ্রহ, বিক্রি ও পরিবহন ইত্যাদি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। সেখানকার নারী থেকে শিশুরাও আম কেন্দ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত। পুরো রাজশাহী অঞ্চলে আমকে কেন্দ্র করে আম বাগানি, বাগান লিজদার, বাগান প্রহরী, বাগান পরিচর্যাকারী, বহনকারী, আড়তদার, অস্থায়ী হোটেল ব্যবসায়ী, ঝড়া আমের কারবারি এসব নানা কর্মের চাঞ্চল্যতা লক্ষণীয়। আম কেটে শুকিয়ে তৈরি করা আমচুর কিংবা আমসত্বের আছে কোটি টাকার বাজার। উৎপাদনের অগ্রগতি ফল আবাদে শীর্ষে কলা ও উৎপাদনে শীর্ষে আম। দেশে বর্তমানে আমের বাজার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিহারে আমের ফলন বাড়ছে। ২০০৫ সালেও বাংলাদেশে মাত্র আড়াই লাখ টন আম উৎপাদন করে বিশ্বের ১৪তম উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ছিল। এফএওর হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে বাংলাদেশে ৮ লাখ ৯০ হাজার টন আম উৎপাদন করে। বিশ্বের অষ্টম আম উৎপাদনকারী দেশটি গত দুই বছরের মধ্যে উৎপাদন বেড়ে ১০ লাখ টনে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সফতম স্থানে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাব বলছে, বাংলাদেশে আম উৎপাদন হয়েছে সাড়ে ১২ লাখ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১১ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৫ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ফলটির উৎপাদন ১২-১৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। জানা গেছে, আম উৎপাদনে দেশে দ্বিতীয় অবস্থানে সাতক্ষীরা। সাতক্ষীরার সাত উপজেলার ৪ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ করা হয়েছে। এবার সাতক্ষীরা সদর, কলারোয়া, দেবহাটা, আশাশুনি ও তালা উপজেলার ৪০০টি বাগান থেকে আম রফতানি করা হবে। চলতি অর্থবছর তা ১৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে নাম ছড়াচ্ছে বাংলার আম আশা জাগানিয়া খবরটি হলো- বাংলাদেশের ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম যুক্তরাজ্যে রফতানি হয়েছে। এফএও’র মতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আম রফতানির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনাটি হলো- বাংলাদেশের আম যখন পাকে তখন বিশ্ববাজারে অন্য কোন দেশের আম আসে না। যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু ফল হিসেবে বাংলাদেশের আমকে বেশ পছন্দ করছে। গুণে ও মানে অতুলনীয় হওয়ায় বিশ্ববাজারে দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশের আমের চাহিদা। রফতানি হচ্ছে ইউরোপ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট কোম্পানি এই আম রফতানি করবে জার্মান, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। এ কারণে সরকার আম উৎপাদনে মাঠ পর্যায তদারকি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকমান বজায় রেখে উৎপাদন করতে পারলে বছরে ১ হাজার টন আম রফতানি করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। ফিলিপিন্স ‘স্পার্জিং’ পদ্ধতিতে বছরের অধিকাংশ সময় আম উৎপাদন করে এবং নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করে থাকে। ভারতও একইভাবে আমি রফতানি করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। আম উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আম হতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য। স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ আম রফতানির নতুন আশা বাংলাদেশের আম নিয়ে বিদেশিদের নেতিবাচক ধারণা কাটতে শুরু করায় ইউরোপের দেশগুলোতে আমের চাহিদা বাড়ছে। এ বছর রফতানির পরিমাণ বেড়ে এক হাজার টনে উন্নীত হচ্ছে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আম রফতানির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনাটি হলোÑ বাংলাদেশের আম যখন পাকে তখন বিশ্ববাজারে অন্য কোন দেশের আম আসে না। যুক্তরাজ্যের ক্রেতারা বিশ্বের অন্যতম সুস্বাদু ফল হিসেবে বাংলাদেশের আমকে বেশ পছন্দ করছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকমান বজায় রেখে উৎপাদন করতে পারলে বছরে ১ হাজার টন আম রফতানি করা সম্ভব হবে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, এ বছর হিমসাগর, ল্যাংড়া, লক্ষণভোগ, আম্রপালি আম রফতানি হবে। ইতালি, স্পেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, গ্রিসসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে আম রফতানি হলেও সবচেয়ে বেশি আম রফতানি হবে যুক্তরাজ্যে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে আম রফতানি করা হয়েছিল প্রায় ৬০০ টন। ২০১৬ সালে রফতানি হয় প্রায় ৩০০ টন। লক্ষ্যপূরণে করণীয় বর্তমানে দেশের ২৫টি উপজেলার চাষিদের আম চাষে সহায়তা দিচ্ছে সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন-আম রফতানির পরিমাণ বাড়াতে হলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিজ্ঞানসম্মতভাবে অধিক উৎপাদনশীল আম গাছ লাগাতে হবে। উন্নতজাতের মিষ্টি ও সুস্বাদু আমের চাষ বাড়াতে হবে। গাছে ফুল ধরা থেকে শুরু করে ফল পাড়ার আগ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ফ্রুট ড্রিংকস ও জুস শিল্প বিকাশে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আম চাষে কৃষকদের সতর্কতা এবং ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন আবহাওয়া উপযোগী আমের নতুন জাত উদ্ভাবন ও পাহাড়ী অঞ্চলে ফলটির আবাদ বাড়াতে হবে। আমকে প্রক্রিয়াজাত করে শিল্প পণ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে বড় ধরনের বাজার সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে হবে। আমচাষীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আমাদের দেশে সঠিক সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে আম আহরণের পর প্রায় ৩৩ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। সঠিকভাবে সংরক্ষণ সম্ভব হলে আম উৎপাদন ও রফতানিতে নতুন সম্ভাবনা হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
×