ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুষ্পিতা রায়

রবি ঠাকুরের সাধারণ মেয়ে

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ১৮ মে ২০১৮

রবি ঠাকুরের সাধারণ মেয়ে

রবি ঠাকুরের লেখায় সৃষ্টি হয়েছিল ‘সাধারণ মেয়ে’ নামে অনবদ্য কবিতা। এটি কবির পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত একটি কবিতা। রবি ঠাকুর একজন সাধারণ মেয়ের গল্প লিখেছেন এই কবিতায়। নায়িকার নাম দিয়েছেন মালতী। কবি পাঠকের সঙ্গে নায়িকার পরিচয়ের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন অপরিচিত এক অন্তঃপুরের মেয়ে হিসেবে। অত্যন্ত সাদাসিধে মেয়ের অসাধারণ মহিমা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এই কবিতায়। মালতী সাধারণ মেয়ে। অসামান্য এক শাণিত আত্মা অনবরত তাকে অদৃশ্যে বিমুগ্ধ রাখে যা প্রকাশে সে একটা সংশয়ে ভোগে। একটা নিগূঢ় দ্বিধা তার সঙ্গে অত্যাসক্ত হয়ে থাকে। অপরিণত বয়সের ভাললাগা তাকে বিচলিত করে রাখে। রবি ঠাকুর নায়কের নাম দিয়েছেন নরেশ। নরেশের মতে তার চোখে কেউ পড়েনি মালতীর মতো। এই অমূল্য উক্তি বিশ্বাসের বীরত্ব মালতীর হয় না। আবার অবিশ্বাসের অভয়ই বা কোথায়? নরেশ পড়ালেখার উদ্দেশ্যে যে বলিতে গমন করে। মাঝে মাঝে মালতীকে চিঠি লিখে। চিঠি পড়ে মালতীর গভীর কৌতূহল জাগে। সে অনুসন্ধিৎসার সাগরে কূল খোঁজে। বিলেতের এতসব বিস্ময়কর, বুদ্ধিদীপ্ত, লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যের মেয়েরা সবাই কি নরেশ সেনকেই আবিষ্কার করতে শুরু করল! দেশে যাকে গণ্য করা হতো অন্য দশ জনের মতো সাধারণ কেউ হিসেবে। সবশেষে পাওয়া চিঠিতে নরেশ লিজি নামের এক মেয়ের সঙ্গে সমুদ্র স্নানের গল্প লিখেছে। সমুদ্র তীরে পাশাপাশি বসে নর্মিল, স্বর্গীয় প্রকৃতি উপভোগ করার দৃশ্য তুলে ধরেছে। নরেশের বিদায় মুহূর্ত তখন ঘনিয়ে আসছে। লিজি খুব ধীরে ধীরে কাব্যিক ভঙ্গিমায়, বিশারদ কিছু শব্দ আর অভিজাত কিছু বাক্য দিয়ে নরেশকে সেই মুহূর্তের জানান দেয়। বিমুগ্ধ নরেশ সেই কথাগুলো চিঠিতে লিখে। লিজির অসামান্য ভঙ্গি আর সম্ভ্রান্ত মনোভাবে আবিষ্ট নরেশের মন মালতী পড়তে পারে। নরেশ আরও উল্লেখ করে লিজির ওই কথাগুলো মিথ্যা হলেও তাকে সত্যের মতোই বিচলিত করেছে। সে লিখে- ‘হীরে বসানো সোনার ফুল কি সত্য? তবুও কি সত্য নয়?’ এই বাক্যে লুকায়িত একটা প্রচ্ছন্ন অবহেলা, একটা অব্যক্ত তিরস্কার মালতীকে নিদারুণ আঘাত করে যায়। অপ্রকাশিত ব্যর্থতা আর অপারকতার নিম্নতায় ক্ষীয়মাণ মালতী তখনই জিতিয়ে দিতে চাইল তার লেখককে। সে তার লেখকের কাছে প্রতিষ্ঠিত করল তার অনুরোধকে। একটা গল্প লেখার অনুরোধ। একটা সাধারণ মেয়ের গল্প যে প্রতিনিয়ত পাল্লা দিয়ে যায় আর পাঁচ সাতজন অসামান্যার সঙ্গে। মালতী তার নিজের অপারকতা সাদরে গ্রহণ করে নিলেও জিতিয়ে দিতে চায় তার লেখকের কলমে জন্ম নেয়া সেই অসাধারণ মেয়েকে। যার গল্প পড়ে গর্বে বুক ফুলে উঠবে, ফুল চন্দন পড়বে লেখকের কলমের মুখে। সেই অসামান্যা মেয়ের নাম সে দিল মালতী। লেখকের কাছে এটা তার অনুরোধ। নিজে হাজারও সাধারণ মালতীর একজন হলেও লেখকের কলমে সে দেখতে চায় অসাধারণ, অসামান্য এক মালতী। সে সাধারণ মেয়ে। ফরাসী, জার্মান জানে না- কাঁদতে জানে। কিন্তু লেখকের মালতী জানুক ফরাসী, জার্মান। দুঃখবিলাসী শকুন্তলার মতো চরম ত্যাগের পথে না নিয়ে লেখক মালতীকে গড়ে তুলুক উচ্চাভিলাষী, অসামান্য, অস্পৃশ্য এক মেয়ে হিসেবে। উচ্চ, মহীয়সী লেখক পৌঁছে যাক সাধারণ মালতীদের সমতলে। লেখকের সেই অসামান্য মালতী পাক দেবতার কাছে চাওয়া অমূল্য বর যা পায়নি হাজারও সাধারণ মালতী। এবার লিখি সেই সাধারণ মালতীর স্বপ্নে বসবাস করা অসামান্য মালতীর গল্প যে ফুটে উঠবে লেখকের কলম তুলিতে। নরশে তখন সাত বছর লন্ডনে। বার বার ফেল করার বিষণœতায় নিমজ্জিত। ইতোমধ্যে লেখকের জোরালো কলমে মালতী গণিতে হলো প্রথম, পাস করল এমএ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এখানইে থামবে না লেখকের কলম। বিধাতার কৃপণতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিততে হবে লেখকের শক্তিধর কলমকে। মালতীকে পাঠানো হোক ইউরোপে। সেখানে জ্ঞানী, বিদ্বান, কবি, শিল্পী, রাজারা আর্শ্চযান্বিতচিত্তে জড়ো হোক মালতীর চারপাশে। জ্যোতর্বিদের মতো আবিষ্কার করুক এক মহিমান্বিত নারীকে। সমজদার, দরদী, ইংরেজ জার্মান, ফরাসিদের কাছে ধরা পড়ুক তার বিশ্ববিজয়ী জাদু। মালতীকে নিয়ে বড় বড় সভা হোক। শহরের অলিতে গলিতে তাকে নিয়ে গল্প হোক। গোটা ভারতবর্ষের সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রৌদ্র মহিমান্বিত রূপে প্রস্ফুটিত হোক মালতীর মোহিনী দৃষ্টিতে। আর নরেশ এসে দাঁড়াক সেই কোণে। সঙ্গে নিয়ে লিজির মতো তার অসামান্য মেয়ে দল। লেখা হয়ে যাক এক সাধারণ মেয়ের বিস্ময়কর বিজয়ের গল্প। কবি এভাবেই শেষ করেছেন। আজ থেকে ৮৬ বছর আগে লেখা কবিতায় কি অদ্ভুত মহিমায় কবি ফুটিয়ে তুলেছেন সাধারণ বাঙালী মেয়েদের বিজয়। কি উচ্চাকাক্সক্ষী, উচ্চাভিলাষী মেয়েদের তিনি তার স্বপ্নে স্থান দিয়েছিলেন। আজ ৮৬ বছর পরে হলেও বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে অবস্থান করার কথা ছিল এমন মেয়েদের। অথচ আজও আমরা পিছিয়ে পড়তে চাই। আজও ভালবাসা নামক মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে বিকিয়ে যাচ্ছে সমাজের অনামিত সব অসাধারণ মেধা। উঠে দাঁড়ানোর এখনই সময়। জাগ্রত হোক নারী হৃদয়। প্রস্ফুটিত হোক এ রকম হাজারও অসামান্য মালতী যারা সাধারণ পরিচয়ে আটকে রয়েছে শহর-গ্রামের অলিতে গলিতে। বিজয় ঘোষিত হোক সেইসব অগণিত সাধারণ মেয়েদের যাদের রবি ঠাকুর তার কলমে সৃষ্টি করেছিলেন অসাধারণ রূপে।
×