ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

নাটম-লে নিচুতলার মানুষেরা

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ১০ মে ২০১৮

নাটম-লে নিচুতলার মানুষেরা

অতীতের স্মৃতি থেকে যতদূর জানা যায়- বাস্তুহারা, ছন্নছাড়া, রাষ্ট্রহারা ও শ্রমজীবী মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা, সবসময়-ই আয়নার মতো স্পষ্ট! হয় কাছ থেকে দেখছি না হয় দূরে থেকে জানছি। আমাদের মধ্যে কারও কারও উদার মানসিকতার প্রভাবে এদের নিয়ে ভাবছি এবং বিচলিত হচ্ছি। তবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ভাবনার প্রভাব অল্প সময়ের। আসলে খুব কম মানুষই হৃদয়ের গভীর থেকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করতে পারে। যে কারণে, কালের সবতালে তারা থেকে আসছে ছন্নছাড়া গলিপথের জীবনে। আলোর পেছনে। পৃথিবীব্যাপী হাতেগোনা কয়েকজন এই অসংখ্য মানব আত্মার মুক্তির তরে সেøাগান তুলেছেন। হৃদয় দিয়ে অনুভব করে তাদের হয়ে আয়াজ তুলেছেন, অনেক ত্যাগের মহিমা দেখিয়েছেন, তাদের মধ্যে সুহৃদ ম্যাক্সিক গোর্কি অন্যতম। গোর্কি তাঁর অমর সৃষ্টকর্মের মধ্যে তাবৎ দুনিয়ার খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষদের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের আশা জাগিয়ে রাখেন, স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখেন- প্রাণের পরতে পরতে। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কেন লেখেন, উত্তরে বলেছিলেন, ‘মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে প্রবল করে তোলার জন্য’ হাতে কলম তুলে নিয়েছি। ‘দ্য লোয়ার ডেপথ্স’ তাঁর এমনি এক সৃষ্টি যা এক রকম মানবিকতাহীন পৃথিবীর বুকে চিরঞ্জীব শক্ত সেøাগান। গত ৬ মে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ তাদের নাটমন্ডলে নাটকটি মঞ্চস্থ করে আসছে। আগামী ১১ মে পর্যন্ত চলবে। ‘দ্য লোয়ার ডেপথ্স’ তৃতীয় বর্ষের পঞ্চম সেমিস্টার প্রযোজনা, নির্দেশনা দিচ্ছেন তানভীর নাহিদ খান। মঞ্চ, আলোক ও দ্রব্যসম্ভার পরিকল্পনা, আশিক রহমান লিয়ন এবং পোশাক ও রূপসজ্জা পরিকল্পনা, কাজী তামান্না হক লিয়ন। অনুবাদ করেছেন তানভীর মেকাম্মেল। সূর্যের আলো হীন, নির্মল বাতাসহীন একটি অস্বাস্থ্যকর মাটির বাড়ির তলার ঘর। যেন এক গভীর কুয়োর তলা। এমনিই এক স্থানে আশ্রয় নিয়েছে কয়েক জন ছন্নছাড়া ভবঘুরে মানুষ। এদের মধ্যে কেউ চোর, কেউ জুয়াড়ি, কেউ জীবনে ব্যর্থ মানুষ, কেউ খেটে খাওয়া শ্রমিক, কেউ কায়িক পরিশ্রম করা মিস্ত্রি, পশম ব্যবসায়ী, মুচি যাদের এক সময় বেঁচে থাকার আশা ছিল স্বপ্ন ছিল, জীবনের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু সদিচ্ছার অভাব, কঠিন পৃথিবীতে জীবনযাপনের নির্মম কষাঘাত ওই মানুষগুলো কে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। ওরা মানুষ হিসেবে হারিয়েছে পরিচয়, যেন অন্ধকারের কোন প্রাণী। এই মানুষগুলোর সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত অভিপ্রায় এবং দীর্ঘশ্বাসের উপলব্ধি ম্যাক্সিম গোর্কি থেকে নাটমন্ডলের অভিনয় শিল্পীরা বেশ ভালভাবেই দর্শনার্থীদের বিচলিত করছে। নাটকের মধ্যখানে যখন বেশিরভাগ চরিত্র এক সঙ্গে চিৎকার করে গেয়ে ওঠে ‘প্রতি ভোরে আমার জানালায় ঠিক-ই সূর্য ওঠে, তবুও আমার কুঠুরি ভীষণ অন্ধকার’ এই গানের লাইনেই বোঝা যাচ্ছে সত্যিই এই মানুষগুলো জীবনে সূর্যের ছায়া নেই। জগতখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর অমর নাটক হ্যামলেটের এক ডায়লকে লিখেছিলেন, নাটকের মূল উদ্দেশ্য হলো বাস্তবতাকে আয়নার মতো করে উপস্থাপন করা। অসলে নাটকের প্রকৃত উদ্দেশ্য তো এটাই। ‘দ্য লোয়ার ডেপথ্স’ এর ব্যারন, ক্লেশ নাস্তিয়া, আন্না, কস্তিলভ, নাতাশা এবং লুকারা আয়নার মতো কারেই দেখতে চেষ্টা করেছেন, দুনিয়ায় পিছিয়ে পরা বা অন্ধকার ঘুপচিতে থাকা অসংখ্য মানুষদের জীবন উপলব্ধি করতে। নাট্যনির্দেশনা, লাইটিং সেট এবং অভিনীত বেশিরভাগ চরিত্র দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। তবে সেট ডিজাইন এবং পরিবর্তনে আরও একটু কৌশলী হলে এই চমৎকার কাজটি আরও বেশি মনোমুগ্ধকর হতো।
×