ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

কিমের সুমতি...

প্রকাশিত: ০৭:৫১, ৯ মে ২০১৮

কিমের সুমতি...

একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচী, পরমাণু বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ, কথায় কথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়াকে দেখে নেয়ার হুমকি, সব মিলিয়ে কিম যেন হয়ে ওঠেছিলেন বিশ্বরাজনীতির মূর্তিমান ত্রাস। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো কিমকে ‘রকেট ম্যান’ নামও দিয়ে ফেলেছেন। সেই কিমের ভোল বদল ঠিক কি কারণে? সিউলের দাবি, গেল মাসে দুই কোরিয়ার শীর্ষ বৈঠকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি ওঠে। সেখানেই উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন জানান, দেশের সবকটি পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র তিনি মে মাসেই বন্ধ করে দেবেন। এমনকি নিরস্ত্রীকরণের কাজে স্বচ্ছতা আনার জন্য মার্কিন ও দক্ষিণ কোরীয় পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানাতেও তিনি নাকি রাজি হয়ে গিয়েছেন। অনেকেই একে বলছেন, আত্মসমর্পণ! অনেকেই আবার এই ভোল বদলের পেছনে দেখছেন চিনের প্রভাব। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হুমকির রাজনীতিতে যে গোটা বিশ্বে এক ঘরে হয়ে পড়তে হবে, সেটা হয়ত কিমকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে চীন। সম্প্রতি চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর থেকেই কিমের সুর নরম। তা ছাড়া একের পর এক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা দুর্বল করে ফেলেছে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিকে। এই রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে চাইছেন কিম নিজেও। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে কিম দাবি করেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর হামলা চালানোর মতো মানুষ আমি নই। আলোচনার মধ্যে দিয়ে যদি সমস্ত সমস্যা মিটে যায়, তবে আর পরমাণু অস্ত্রের কী দরকার?’ পরমাণু অস্ত্রে কিমের এই বৈরাগ্যে আরেকটি বিষয়ে আলো ফেলছেন বিশেষজ্ঞরা। সামনেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা কিমের। সেই বৈঠক থেকে কিছু ফায়দা আদায়ের কথা ভেবেই তিনি হাঁটতে রাজি হয়েছেন পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের পথে। বিনিময়ে হয়ত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাবেন কিম। উঠতে পারে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সরিয়ে নেয়ার কথা। বিষয়গুলো নেহাত উড়িয়ে দেয়ারও উপায় নেই। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় কিম যুক্তরাষ্ট্র প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমেরিকা বরাবরই উত্তর কোরিয়ার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। কিন্তু আমেরিকা বা দক্ষিণ কোরিয়ায় পরমাণু অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানোর মানুষ আমি নই। আমেরিকা আক্রমণ না করলে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ হবে। এ বার থেকে ঘন ঘন বৈঠক করে আমেরিকার সঙ্গে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটা যদি তৈরি করা যায়, তা হলে পরমাণু অস্ত্র রাখার কোন কারণই নেই। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যুদ্ধ আর আগ্রাসী মনোভাবের দিন শেষ।’ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্ভাব্য বৈঠক সামনে রেখে পরমাণু অস্ত্র প্রসঙ্গে কিমের এই ঘোষণা তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধে দীর্ঘদিন ধরেই চাপ দিচ্ছে আমেরিকা। এদিকে দুই কোরিয়াকে কাছাকাছি আনার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন আমেরিকার প্রশংসা করেছেন বার বার। তার মতে, দক্ষিণ কোরিয়ার মিত্র দেশটির সহযোগিতা ছাড়া এ সাফল্য আসত না। তবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই পরমাণু অস্ত্রের ক্ষেত্রে কিমের প্রতিশ্রুতি এখনই চোখ বুজে বিশ্বাস করছে আমেরিকা। কূটনীতিকদের দাবি, ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের আগে পেন্টাগন থেকে শুরু করে সবকটি সংশ্লিষ্ট দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এখন পিয়ংইয়ংয়ের প্রতিটি পদক্ষেপ জরিপ করবে পাখির চোখে। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে ঘোষণা পত্রে কিম সই করলেও এ নিয়ে তার সরকার কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে, তা নিয়ে মুখ খোলেননি তিনি। পড়শি দক্ষিণ কোরিয়া অবশ্য মোটামুটি আশ্বস্থ যে, পরমাণু ভাণ্ডার কমানোর বিষয়টি নিয়ে কিম এ বার সত্যিই দায়বদ্ধ। কিম আর মুনের প্রশংসা শোনা গেছে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখেও। দুই কোরিয়ার ঐতিহাসিক বৈঠক নিয়ে ট্রাম্পকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ আর উত্তর কোরিয়ার ঐতিহাসিক বৈঠকের জন্য দু’দেশকেই আমি অভিনন্দন জানাতে চাই। কোরীয় উপদ্বীপে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন আর কিম জং উন যে দায়বদ্ধতা দেখিয়েছেন, তা দেখে আমরা উৎসাহী। আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কিম জং-উনের সঙ্গে আমি বৈঠকে বসতে চলেছি। আমি আশাবাদী, সেই বৈঠকও ফলপ্রসূই হবে।’ সেই সঙ্গে ট্রাম্প যোগ করেন, ‘অনেকগুলো দশক সময় লেগে গেল। দেখা যাক এর পর কী হয়।’ ট্রাম্প-কিম বৈঠক সামনে রেখে দুই দেশের কর্তারা আমেরিকার বাইরে পাঁচটি জায়গার খোঁজ করছেন। এদিকে বৈঠকের ক্ষেত্র তৈরি করে রাখতে ট্রাম্প, সাবেক সিআইএ প্রধান, বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে গত মাসে পাঠিয়েছিলেন উত্তর কোরিয়ায়। তবু নিঃসংশয় হতে না পেরে ডোনাল্ড ট্রাম্প সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, কিম জং উনের সঙ্গে আলোচনা ফলপ্রসূ না হলে ‘ওয়াক আউট’ করবেন তিনি!। পম্পেও এবং উত্তর কোরিয়ার শাসকের আলোচনা প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেই টুইট করেছিলেন, ‘কিমের সঙ্গে পম্পেওর আলোচনায় উঠে আসা বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে শুধু গোটা বিশ্বের নয়, উত্তর কোরিয়ারও ভাল হবে।’ পম্পেও-কিমের এই বৈঠক ছিল ২০০০ সালের পরে দুই দেশের মধ্যে এত উচ্চ পর্যায়ে প্রথম। এর কৃতিত্ব নিতেও কসুর করছেন না ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্টের দাবি, পূর্বসূরিরা যা করতে পারেননি, তার প্রশাসন সেটাই করে দেখিয়েছে। তার ভাষায়, ‘অন্যরা বহু বছর ধরে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’ অর্থাৎ ট্রাম্প এটিকে দেখছেন ব্যক্তিগত অর্জন হিসাবে। অর্জনের ঝুলি আরও ভারি করতে, নিজ দেশে কোণঠাসা ট্রাম্পও যে কিমের সঙ্গে বৈঠক থেকে সুবিধা নিতে চাইবেন সেটাও স্বাভাবিক। পম্পেওর সঙ্গে কিমের ঠিক কী বাতচিত হয়েছে, তা জানা না গেলেও কিমের সুর বদলে সে আলোচনারও প্রভাব রয়েছে সেটাও নিশ্চিত। যতই হুমকি-ধমকি দিয়ে বেড়ান না কেন, নিজ দেশে কিমও কিন্তু খুব একটা স্বস্তিতে নেই। নিষেধাজ্ঞার কারণে বিধ্বস্থ অর্থনীতির বোঝা বইতে হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার সাধারণ নাগরিকদের। মিত্র চীনও খুব ভাল চোখে দেখছিল না কিমের অবস্থানকে। বহির্বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা নেমে এসেছিল শূন্যের কোটায়। ভাল যাচ্ছিল না দিন। সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে ছিল না বিকল্প। সব মিলিয়ে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে কিমের প্রতিশ্রুতি, পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মরিয়া চেষ্টা বলেই গন্য হচ্ছে। কিমের এই প্রতিশ্রুতি কতটা আন্তরিক সংশয় আছে তা নিয়েও, কিম কিন্তু পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন তার প্রতিশ্রুতির অর্থ কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার নয়। তা সত্ত্বেও কোরীয় যুদ্ধ ও তার পরবর্তী তিক্ততা ভুলে দীর্ঘ ৬৫ বছর পরে দক্ষিণের মাটিতে উত্তরের কোন শাসকের পা রাখা, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে কিমের প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বশান্তির পক্ষে বড় একটি অগ্রগতি বলেই গণ্য করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×