ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২২ এপ্রিল ২০১৮

দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের তালিকায় যোগ হলো আরেকটি নাম। শুক্রবার রাতে মহাখালীতে পাল্লাপাল্লি করে যাওয়ার সময় দোতলা বিআরটিসি বাসের চাপায় ডান পা হারান রাজিয়া খাতুন নামের এক যুবতী। সংসারের একমাত্র ব্যক্তির এমন পরিণতিতে দিশেহারা পুরো পরিবার। আহত রাজিয়া ও তার পরিবারের আর্তনাদে হাসপাতালের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আছে। বিআরটিসির ঘাতক বাস নিয়ে চালক পালিয়ে গেছে। চালকসহ বাসটি আটকে চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সদ্য পঙ্গুত্ববরণ করা রাজিয়া খাতুনের (১৯) বরাত দিয়ে তার ভগ্নিপতি মানিক জনকণ্ঠকে জানান, বান্ধবির কাছ থেকে বেড়িয়ে বাসায় ফিরছিল। অনেক মানুষ রাস্তা পার হচ্ছিলেন। সেও পার হচ্ছিল। আচমকা সে পা পিছলে পড়ে যায়। তখন দুটি বাস পাল্লাপাল্লি করে মহাখালী থেকে বনানী-কাকলীর দিকে যাচ্ছিল। পাল্লাপাল্লি করে যাওয়ার সময় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস তাকে চাপা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার ডান পা হাঁটু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দ্রুত পুলিশ তাকে উদ্ধার করে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (সাবেক পঙ্গু) ভর্তি করে। শনিবার বেলা এগারোটার দিকে রাজিয়াকে হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ কক্ষে তীব্র যন্ত্রণায় কাঁদতে দেখা যায়। তাকে ঘিরে পরিবারের সদস্যরাও কাঁদছিলেন। পাশেই হাসপাতালের পরিচালক গণি মোল্ল্যা দাঁড়িয়ে ছিলেন। সঙ্গে চিকিৎসকরা। পরিচালক জনকণ্ঠকে জানান, রাতেই রাজিয়ার অপারেশন হয়েছে। হাঁটুর নিচ পর্যন্ত কেটে পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে। রাজিয়া আপাতত শঙ্কামুক্ত। পরে তাকে হাসপাতালের দোতলার ডি-ব্লকে নারী ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। মেয়েকে দেখতে ছুটে এসেছেন পিতা রসুল মিয়াসহ পরিবারের লোকজন। রসুল মিয়ার (৫৭) কাছে মেয়ের বিষয়ে জানতে চাইতেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বলেন, আমার আর কোন উপায় নেই। সামনে সবকিছু অন্ধকার দেখছি। কারণ রাজিয়ার রোজগারে পুরো সংসার চলে। তার পঙ্গু হয়ে যাওয়া আল্লার গজব ছাড়া কিছু নয়। আমাদের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া থানাধীন কলিকাবাড়ি গ্রামে। আমি হার্টের রোগী। ’১৫ সাল থেকে ভুগছি। আমার স্ত্রী রাবিয়া খাতুন (৪৫) জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত। সে প্রায় সারাক্ষণই বিছানায় শুয়ে থাকে। আমরা স্বামী-স্ত্রী কোন কাজ করতে পারি না। আমার তিনবার স্বল্প আকারে হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। হাতের কয়েকটি আঙ্গুল অচল। সংসারে রোজগার বলতে তেমন কিছুই নেই। সামান্য কৃষি জমি আছে। তাই চাষ করি। অনেক বড় সংসার। সংসারে আমরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও ছয় সন্তান। বড় মেয়ে রমিজা খাতুনের (২২) বিয়ে হয়েছে। দ্বিতীয় মেয়ে রাজিয়া খাতুন। রাজিয়া প্রায় আট বছর ধরে গুলশানের নিকেতনের একটি বাড়িতে মাসিক আট হাজার টাকায় গৃহকর্মীর কাজ করছে। সে ওই বাড়িতেই থাকে। কাপড়চোপড়সহ যাবতীয় খরচ বাড়ির মালিক বহন করেন। তাই মাসিক বেতনের পুরো টাকাই আমাদের দেয় রাজিয়া। সেই টাকায় আমাদের সংসার চলে। তার পঙ্গু হয়ে যাওয়ায় আমরাও পঙ্গু হয়ে গেলাম। আমাদের কীভাবে সংসার চলবে আল্লাহ জানেন। রাজিয়ার পর ফজিলা খাতুন (১৭)। সে তেমন কিছুই করে না। এরপর তানজিলা খাতুন (১৫), একমাত্র ছেলে আব্দুল্লাহ (১৩)। সবার ছোট মেয়ে আনজিলা খাতুন (১০)। তারা তেমন কিছুই করে না। এসব বলার পরেই আবার হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন তিনি। মেয়ের শোকে কোন কথা বলতে পারছিলেন না। শুধুই কাঁদছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই সড়ক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যু আর চিরতরে পঙ্গুত্বের মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম। এর আগে গত ৩ এপ্রিল দুপুর দেড়টার দিকে কাওরানবাজার সার্কফোয়ারার কাছে পাল্লাপাল্লি করে যাওয়ার সময় দোতলা বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের বাসের মধ্যে ঘষাঘষিতে দোতলা বাসের যাত্রী তিতুমীর সরকারী কলেজের ছাত্র এতিম রাজীব হোসেনের (২২) ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজীবের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু সারাদেশকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। কারণ রাজীব টিউশনি ও একটি কম্পিউটারের দোকানে চাকরি করে এতিমখানায় থেকে পড়াশুনারত ছোট দুইটি ভাইয়ের খরচ যোগাত। হাইকোর্ট রাজীবের পরিবারকে এককোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এমন ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ১৬ এপ্রিল সকালে খোদ রাজধানীর পলাশীতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি বাস ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক দেলোয়ার হোসেনকে চাপা দেয়। এতে পুলিশ কর্মকর্তার বাঁ পা বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে পুরোপুরি থেঁতলে যায়। ওই পা কেটে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন এ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই হার্টএ্যাটাক হয় পুলিশ কর্মকর্তার। তাকে রাজধানীর পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। বাইপাস সার্জারির রোগী পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। পুলিশ কর্মকর্তাকে চাপা দেয়ার পরদিন গত ১৭ এপ্রিল সকাল সাড়ে দশটার দিকে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বেদগ্রামে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ট্রাকের ঘষায় কাঁধ থেকে ডান হাত পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় টগবগে যুবক খালিদ হাসান হৃদয়ের। বাবার চাকরিতে সহায়তা করতে যাওয়ার সময় ঘটনাটি ঘটে। একমাত্র পুত্রের চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার ঘটনায় পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
×