ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বৈশাখী মেলা বাংলা একাডেমিতে

গ্রামীণ জীবনের ছবি লোক ঐতিহ্যের মায়া, বাহারি পণ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৮ এপ্রিল ২০১৮

গ্রামীণ জীবনের ছবি লোক ঐতিহ্যের মায়া, বাহারি পণ্য

মোরসালিন মিজান ॥ পহেলা বৈশাখ মানেই লোক ঐতিহ্যের মেলা। গ্রাম-গঞ্জে এ ধরনের মেলা একসময় খুব দেখা গেছে। এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ সংস্কৃতির মেলা হয় ঢাকাতেও। বর্তমানে যেমন চলছে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। ১৪২৫ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। প্রতিবছর একই সময়ে অভিন্ন জায়গায় আয়োজন করা হয় বলে অনেকেই মেলার চরিত্রটি সম্পর্কে জানেন। হ্যাঁ, মূল উদ্যোগ বিসিকের। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোক ও কারুশিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। এবারও এসেছেন। নিজেদের তৈরি পণ্য দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন তারা। শতাধিক স্টল। শহুরে শৌখিন মানুষ আপন মনে দেখছেন। চলছে নানন্দিক কেনাকাটা। গত কয়েকদিন মেলা ঘুরে দেখা যায়, শতাধিক স্টলে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প পণ্যের সম্ভার। মেলায় রয়েছে মৃৎশিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, নক্সিকাঁথা, শতরঞ্জি, কাঠজাতপণ্য। বেশ কয়েকটি স্টলে ঐতিহ্যবাহী জামদানি ও তাঁতের শাড়ি। হাতের কাজ করা থ্রিপিস। বিছানার চাদর। ঝিনুকপণ্য, পুঁতির মালা পাওয়া যাচ্ছে। আছে লোকজ বাদ্যযন্ত্র। গ্রামীণ মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ নাগরদোলা, পুতুল নাচÑ কী নেই! সব মিলিয়ে বৈশাখী মেলা। মেলায় মৃৎশিল্পের একাধিক স্টল। রাজশাহীর একটি স্টলে নানা আকার আকৃতির টেপা পুতুল। একেবারে ট্রাডিশনাল পুতুল বলতে যেগুলোকে বোঝায়, সেগুলো সুন্দর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রায় পুতুলের যে ফর্মগুলো বেশি ব্যবহৃত হয় সেগুলো দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। যে হাত দিয়ে বানানো সেই শিল্পীও ছিলেন স্টলে। নাম বিজলী। সরল উচ্চারণে বললেন, ‘পুতুল হলো মনের চয়েস। মনের দিক দিয়ে তৈরি।’ অর্থাৎ মনের কল্পনাকে প্রাধান্য দিয়েই পুতুল তৈরি করেন তিনি। কেউ শিখিয়ে দেন না। তবে পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া লোকজ ফর্মগুলো তারা ভালবেসে বাঁচিয়ে রেখেছেন বলে জানান তিনি। পাশেই শখের হাঁড়ি। স্টলে ঝুলিয়ে রাখা রঙিন হাঁড়িগুলোর দিকে অপনি চোখ চলে যায়। মূল রংটি হলুদ। এর ওপর লাল কালো সাদা সবুজ তুলির আঁচড়। ফুল-লতা-পাতার নক্সা। এক সময় কুটুমবাড়িতে মিষ্টি পিঠা ইত্যাদি পাঠাতে শখের হাঁড়ি ব্যবহার করা হতো। এখন সেই ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। ঐতিহ্যবাহী শখের হাঁড়ি ব্যবহৃত হচ্ছে শোপিস হিসেবে। বিভিন্ন আকারের হাঁড়ি একটির ওপর আরেকটি বসিয়ে চমৎকার সেট তৈরি করা হয়েছে। স্টলে খুঁজে পাওয়া গেল রাজশাহীর বিখ্যাত শিল্পী সুশান্ত কুমার পালের দুই ছেলেকে। একজনের নাম সঞ্জয় কুমার পাল। শখের হাঁড়িতে তুলির আঁচড় দিচ্ছিলেন তিনি। জানালেন, এটি তাদের বাবা দাদাদের পেশা। পেশাটার প্রতি তাই অন্যরকম ভালবাসা কাজ করে। শখের হাঁড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে কাজ করে যাবেন বলে জানান তারা। গ্রামীণ জীবনে বাঁশ ও বেত শিল্পের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দীর্ঘকাল ধরে বাঁশ দিয়ে পণ্য তৈরি করছেন দিনাজপুরের প্রবীণ শিল্পী নির্মল। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। অন্য একটি স্টলে বাঁশের বাঁশি। ছোট-বড়-মাঝারি আকারের বাঁশি পলিথিনে যতœ করে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। কোনটির নাম মুখ বাঁশি। কোনটি আঁড় বাঁশি। কারিগর এলিফ্যান্ট রোডের লাল মিয়া। বললেন, বাঁশি আমাদের ঐতিহ্য। বাঁশের বাঁশি যারা বাজান তারা আমাকে চেনেন। ছুটে আসেন। মেলায়ও বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি। মেলায় যোগ দিয়েছেন শোলা শিল্পীরা। শোলা কেটে তারা তৈরি করেছেন ফুল ও পাখি। আছে পালকি এবং গরুর গাড়ি। স্টলে বসে কাজ করছিলেন প্রবীণ শিল্পী গুপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বললেন, একেবারে শৈশব থেকেই শোলা শিল্পের কাজ করছি। যেখানে মেলা হয় সেখানেই যোগ দেয়ার চেষ্টা করি। এভাবে শোলা শিল্প টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখে চলেছেন এই প্রবীণ। ধামরাই থেকে এসেছেন দিলীপ সরকার। কাঁসা ও পিতল শিল্পের নিদর্শন দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন তিনি। মেলায় আছে আছে রংপুরের বিখ্যাত শতরঞ্জি। আছে মুন্সীগঞ্জের শীতলপাটি। গ্রামীণ মেলা যেহেতু, মিষ্টি, মুড়ি-মুড়কি থাকবেই। চোখে পড়ল সোনারগাঁওয়ের লাঙ্গলবন্দ থেকে আসা কারিগরদের বড় একটি স্টল। এখানে কদমা, বাতাসা, মোড়ালি, আঙ্গুরী, আমিরতি, উখড়া, নিমকি, নকুল দানা, লাড্ডু। তবে বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার কারণে মেলা এবার বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিকাংশ স্টলের নিচে পানি জমে ছিল। ক্রেতাও তাই কম। জলের ওপর ইট বিছানো পথে দাঁড়িয়ে কথা হয় রুহির সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বললেন, প্রতিবছরই এখানে আসি। পহেলা বৈশাখে আসতে চেয়েছিলাম। বৃষ্টির জন্য পারিনি। তাই আজ এসেছি। বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেকগুলো স্টল ঘুরে দেখা সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি। স্ত্রীকে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন হাবিুর রহমান। তিনি বলেন, এই মেলায় ব্যতিক্রমী অনেক কিছু পাওয়া যায়। গ্রামীণ ঐতিহ্যের পণ্য বলে একটা ভাললাগাও কাজ করে। কী কিনবো আগে থেকে ঠিক করা থাকে না। ঘুরে দেখে যা পছন্দ হয় তাই কিনি। তবে এবার মেলার কর্তৃপক্ষ আয়োজনটির ব্যাপারে উদাসীন বলে অভিযোগ করেন তিনি। দশ দিনব্যাপী মেলা চলবে আগামী সোমবার পর্যন্ত।
×