ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টেকনাফ থেকে ইঞ্জিনবোটে ৫৬ রোহিঙ্গাকে থাইল্যান্ড উপকূলে নিয়ে যায় দালাল চক্র

সাড়ে তিন বছর পর সমুদ্রপথে ফের মানবপাচার

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩ এপ্রিল ২০১৮

সাড়ে তিন বছর পর সমুদ্রপথে ফের মানবপাচার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ কক্সবাজার উপকূল দিয়ে সাগর পথে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বন্ধ থাকার পর এখন নতুন করে এ অবৈধ তৎপরতা আবারও শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫৬ রোহিঙ্গা বোঝাই বড় আকৃতির একটি ইঞ্জিন বোট থাইল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে সেদেশের নৌবাহিনী ধাওয়া দেয়ার পর গভীর সমুদ্রে চলে যায়। পরে সেখানকার অদূরবর্তী উপকূলের আরেকটি স্থানে বৈরী আবহাওয়ার কারণে রোহিঙ্গাবাহী নৌকাটি থামার পর থাই নৌবাহিনী তাদের আটক করে। তবে পরে তাদের আবার ছেড়ে দেয়া হয়। গত রবিবার এ ঘটনা ঘটে। দায়িত্বশীল একটি সূত্রে সোমবার এ তথ্য জানিয়ে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা বোঝাই ঐ ইঞ্জিন চালিত নৌকার গন্তব্য ঠিক কোথায় তা জানা না গেলেও দালাল চক্র এদের মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া উপকূলে নামিয়ে দিয়ে সটকে পড়তে পারে। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা অতীতে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত এমনকি অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা হয়ে। বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূলবর্তী বিভিন্ন পয়েন্টকে দালাল চক্র মানব পাচারের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করেছে। বিগত সাড়ে তিন বছর আগে দলে দলে রোহিঙ্গাদের সাগর পথে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানোর সময় কয়েকটি ইঞ্জিন বোট ডুবে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এতে প্রাণ হারায় বহু। আবার মালয়েশিয়া পাচারের পথে থাইল্যান্ড উপকূলে অনেককে জিম্মি করে রাখা হতো। অতীতে থাইল্যান্ডে পাচার হওয়া অনেকের গণকবরও আবিষ্কৃত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। গত বছরের অক্টোবর ও আগস্ট মাস থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে। এ সংখ্যা এখন ১২ লক্ষাধিক। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ বসতি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে আদর্শ বৌদ্ধ পল্লী। এমনকি কোথাও কোথাও সেনা ক্যাম্পও নির্মাণ করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও নির্মাণ করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পর সেখানে রাখার জন্য আশ্রয় ক্যাম্প। এ ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেও মিয়ানমার প্রত্যাবাসন প্রশ্নে নীরব ভূমিকায় রয়েছে। এছাড়া ব্যাপকভাবে নির্যাতিত হওয়ার পর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তারাও নিজ দেশে ফিরে যেতে খুব বেশি ইচ্ছুক নয়, প্রাণহানির আশঙ্কা থাকায়। কেননা, গত আগস্ট মাসে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানে ন্যূনতম পক্ষে ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের একটি অংশ যেমন বাংলাদেশ থেকে সাগর পথে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে ইচ্ছুক তেমনি পাচারকারী সিন্ডিকেট চক্রও এ নিয়ে তৎপর হয়েছে। কিন্তু অতীতে মানব পাচারে এই রুটে নৌকা ডুবে প্রাণহানির বিভিন্ন ঘটনায় বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ সাগর পথে তাদের নজরদারি বৃদ্ধি করে। ফলে দীর্ঘদিন মানব পাচার তৎপরতা অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মানবপাচারকারী সদস্যরা এখন নতুন করে তৎপর হয়েছে। মানব পাচারের নতুন তৎপরতায় এবার এ খবরটি প্রথম বেরিয়ে এলো। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ৫৬ নারী-পুরুষ ও শিশুসহ গত রবিবার যে দলটিকে নিয়ে মানব পাচারকারী চক্র সাগর পথে ইঞ্জিন বোটযোগে রওনা দিয়েছে তাদের গন্তব্য মালয়েশিয়া উপকূল। মালয়েশিয়া বৈধ-অবৈধ বহু রোহিঙ্গা রয়েছে। অনেকে জেলও খাটছে। ইন্দোনেশিয়াও রয়েছে। কিছু রয়েছে ভারতে। শুধু তাই নয় সাগর পথে সুদূর অস্ট্রেলিয়াও রয়েছে বহু রোহিঙ্গা। অস্ট্রেলিয়া সরকার এদের রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের স্বগোত্রীয় বিদেশে অবস্থানরতদের সঙ্গে মোবাইলে নিত্য যোগাযোগ রয়েছে। সেখান থেকে এরা কোন পথে কিভাবে কোথায় যেতে হবে তার দিক-নির্দেশনা প্রদান করে থাকে। রাখাইন রাজ্য থেকে সাগর পথে বিদেশে অবৈধভাবে যাওয়ার সুযোগ অনেকটা রুদ্ধ। সঙ্গতকারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ অর্থাৎ কক্সবাজার উপকূল হয়ে বিদেশে যাওয়া অবৈধ রুটটি ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে গোটা কক্সবাজার জেলায় রোহিঙ্গা সদস্যদের নিয়ে সয়লাব হয়ে আছে। আশ্রয় ক্যাম্প রয়েছে টেকনাফ ও উখিয়ায়। এছাড়া অবৈধভাবে যত্রতত্র বসতি গেড়েছে অনেকে। কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভে কাছাকাছি এলাকা পর্যন্ত ছুঁইয়েছে রোহিঙ্গা শিবির। সমুদ্র সংলগ্ন টেকনাফের শাপলাপুরে আশ্রয় ক্যাম্প স্থাপিত হওয়ায় সাগর পথে রোহিঙ্গাদের পাচারের বড় একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে অবাধ যাতায়াতের রোহিঙ্গাদের কোন বাধা নেই। অনুরূপভাবে টেকনাফ উপকূলজুড়ে রোহিঙ্গারা যত্রতত্র চলাফেরা করে থাকে। এ অবস্থায় পুরনো মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটগুলো আবার নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সূত্র জানায়, উখিয়া-টেকনাফ এলাকার ১২ অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্পে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের নতুন করে যাচাই-বাছাই করা হয়ে অনেকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। এরা ঠিক কোথায় গেছে, আবার সাগর পথে পাচার হয়ে গেছে কিনা তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছে। বিশেষ করে বহু আগে থেকে যেসব রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ায় রয়েছে তারা দালালদের কাছে অর্থ দিয়ে পরিবারের সদস্যদের পৌঁছে দেয়ার জন্য তৎপর হয়েছে। এদিকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট গ্রহণের ক্ষেত্রে নজরদারি কড়াকড়ি থাকায় রোহিঙ্গারা অবৈধ পথে বিদেশী পাড়ি জমানোর জন্য উৎসাহী। মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে কর্মরত এনজিও হেল্প কক্সবাজারের নির্বাহী এম আবুল কাশেম সোমবার জনকণ্ঠকে জানান, সমুদ্র পথে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আবারও রোহিঙ্গারা পাচার হচ্ছে বলে তারাও জানতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে সংস্থার ভোলানটিয়ারদের তৎপর করা হয়েছে। সম্প্রতি পাচারকালে দুই রোহিঙ্গা নারীকে উখিয়ার সোনার পাড়ার থেকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে স্থানীয়রা। হেল্প নির্বাহী এম আবুল কাশেম জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কতিপয় মাঝি ও মানব পাচারকারী দালালদের সঙ্গে যোগসাজশে রোহিঙ্গাদের সমুদ্র পথে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েও মিয়ানমার এখন নীরব ভূমিকায় রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষে আবারও কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান চাই শান্তিপূর্ণ উপায়ে। পক্ষান্তরে মিয়ানমার এই ইস্যুর জন্ম দিয়ে সমাধানের পরিবর্তে তা আরও কঠোরতম অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান। বিভিন্ন সূত্রমতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে ঠেলে দিতে পারলেই দেশটির সরকার ফের তাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে তেমন কোন তৎপরতা দেখায় না। এ ধরনের বহু নজির রয়েছে। অন্তত সাড়ে তিন বছর আগে মিয়ানমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে বাংলাদেশে আশ্রিত ২ হাজার ৪১৫ জন রোহিঙ্গাকে তারা দুই মাসের মধ্যে ফেরত নেবে। মিয়ানমার সরকার ২০১৪ সালে ২ হাজার ৪১৫ জনকে রাখাইনের বাসিন্দা বলে ফিরতে ওই সময় ‘অনাপত্তি সনদ’ দিয়েছিল। কিন্তু প্রায় সাড়ে তিন বছর পার হয়ে গেলেও মিয়ানমারের দেয়া সেই প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয়নি। ওই সময় উখিয়া-টেকনাফের দুটি শিবির ও একাধিক বস্তিতে অবস্থান করছিল প্রায় দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট ঢাকায় দু’দেশের পররাষ্ট্র সচিবদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর আশ্বাস দিয়েছিল মিয়ানমার। কিন্তু তারা ২ হাজার ৪১৫ রোহিঙ্গাকে ফেরত তো নেয়নি, বরং আরও প্রায় ১০ লাখের বেশি নতুন রোহিঙ্গাকে ঠেলে দিয়েছে বাংলাদেশে। এখনও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। নানা টাল বাহনায় তারা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নিতে কালক্ষেপণ করছে। এদিকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকা মিয়ানমারে হস্তান্তর করলেও সেখান থেকে ৫৫৯ জনকে (প্রথমে ৩৭৪, পরে ১৮৫) রাখাইনের আদি বাসিন্দা বলে স্বীকার করে বাংলাদেশকে ফিরতি তালিকা দেয় মিয়ানমার। তবে তাদেরও মিয়ানমার এ পর্যন্ত ফেরত নেয়ার ক্ষেত্রে কোন তৎপরতা রাখছে না। কবে নাগাদ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে পারবে, তাও এখন পর্যন্ত জানায়নি মিয়ানমার সরকার। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ ১ হাজার ৬৭৩ পরিবারের ৮ হাজার ৩২ রোহিঙ্গার প্রথম প্রত্যাবাসন তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছিল। আরও ১০ হাজার রোহিঙ্গার নামের তালিকা অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
×