ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

জাপানী নাগরিক কুনিও হত্যা মামলার পিপি রথীশ ভৌমিক নিখোঁজ

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ১ এপ্রিল ২০১৮

জাপানী নাগরিক কুনিও হত্যা মামলার পিপি রথীশ ভৌমিক নিখোঁজ

গাফফার খান চৌধুরী/আব্দুর রউফ সরকার ॥ রংপুরে জঙ্গীদের হাতে খুন হওয়া জাপানী নাগরিক হোশি কুনিও এবং মাজারে খাদেম হত্যা মামলার প্রধান সরকারী আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের রহস্যজনক নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার ভোরে রংপুর থেকে নিখোঁজের পর শনিবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই আইনজীবীর সন্ধান মেলেনি। এ নিয়ে রংপুরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। নিখোঁজ আইনজীবীর সন্ধান না মিললে বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করায় রংপুর-লালমনিরহাটের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ প্রায় সাত ঘণ্টা বন্ধ ছিল। পরে পুলিশ দ্রুত আইনজীবীকে উদ্ধারের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি শনিবার বিকেল চারটায় স্বাভাবিক হয়। রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলছেন, নিখোঁজের সঙ্গে বাবু সোনার বাসায় থাকা নগদ ৪০ লাখ টাকার কোন যোগসূত্র আছে কিনা তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোন জঙ্গী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা জামায়াত-শিবির চক্র বা জমি বিক্রির সঙ্গে যারা জড়িত তারাও টাকার লোভে প্রলোভনে ফেলে বাবু সোনাকে কৌশলে অপহরণ করতে পারে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে রংপুর নগরীর বাবু পাড়ার নিজ বাড়ি থেকে বের হন আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। তিনি বহুল আলোচিত রংপুরে জাপানী নাগরিক হোশি কুনিও এবং মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার প্রধান সরকারী আইনজীবী। এছাড়া তিনি রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের রংপুর বিভাগের ট্রাস্টি এ্যাডভোকেট ও তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। নিখোঁজের খবরে শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বেলা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নগরীর তাজহাট এলাকায় রংপুর-কুড়িগাম সড়ক অবরোধ বিক্ষোভ করে। এতে সারাদেশের সঙ্গে কুড়িগ্রাম ও লালমনিহাট জেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। বিকেল চারটা পর্যন্ত রাস্তায় যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ ছিল। পরে পুলিশের তরফ থেকে নিখোঁজ আইনজীবীকে দ্রুত উদ্ধারের আশ্বাস দিলে বিক্ষোভকারীরা শান্ত হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। নিখোঁজ এ্যাডভোকেট রথীশের ছোট ভাই সাংবাদিক সুশান্ত ভৌমিক জানান, নানা জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর শেষ পর্যন্ত শুক্রবার রাত এগারোটার দিকে পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়। শুক্রবার সকালে তিনি বাড়ি থেকে বের হন। নিখোঁজের পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার ভাইয়ের পরিচালনায় একাধিক মামলায় কয়েক জঙ্গীর ফাঁসিও দিয়েছে আদালত। এছাড়া তার ভাই যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলামের মামলার সাক্ষী। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল এটিএম আজাহারুল ইসলামের মৃত্যুদ-াদেশ প্রদান করে। বর্তমানে মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। সুশান্ত ভৌমিকের দাবি, তার ভাইকে কোন জঙ্গী সংগঠনের ক্যাডার অথবা জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীরা অপহরণ করতে পারে। তাকে দ্রুত উদ্ধারের জন্য তিনি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। কোতোয়ালি থানার ওসি বাবুল মিয়া জানান, এ্যাডভোকেট রথীশের সন্ধানে পুলিশ, র‌্যাব ও পিবিআই কাজ করছে। র‌্যাব-১৩ রংপুর জোনের কমান্ডিং অফিসার মেজর আরমিন রাব্বি জানান, আইনজীবীর সন্ধানে অভিযান চলছে। জানা গেছে, বাবু সোনা নিখোঁজের ঘটনায় পুলিশ বেশকিছু সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে। হোশি কুনিও এবং মাজারের খাদেম হত্যা মামলা চলার সময় জঙ্গীরা তাকে দুই দফায় হুমকি দিয়েছিল বলে ওই সময় সাংবাদিকদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবেই দাবি করেছিলেন নিখোঁজ আইনজীবী। বিষয়টি জানানো হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে পরিবারের অভিযোগ। প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় তাভেলা সিজার নামে এক ইতালীয়কে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে যুবদলের একাধিক নেতা গ্রেফতার হয়। এমন ঘটনার ৫ দিনের মাথায় রংপুরে দিনদুপুরে ফিল্মিস্টাইলে জাপানী নাগরিক হোশি কুনিওকে হত্যার ঘটনা ঘটে। দুটি ঘটনার পরই আইএস হত্যার দায় স্বীকার করে বলে জঙ্গী তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের নামে বিবৃতি প্রকাশিত হয়। যদিও ওই সময়ই সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হয়, দেশে আইএসের কোন তৎপরতা নেই। এ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক ওরফে বাবু সোনা নিখোঁজের বিষয়ে রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বাবু সোনা তার অত্যন্ত পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। জঙ্গীদের তরফ থেকে হুমকি পাওয়ার পর আমি নিজেই বাবু সোনার নিরাপত্তার জন্য গানম্যান দেয়ার প্রস্তাব করি। কিন্তু তিনি অজ্ঞাত কারণে গানম্যান নেননি। সম্প্রতি বাবু সোনা জমি বিক্রি করেন। জমি বিক্রির ৪০ লাখ টাকা দুই দিন আগে ইদ্রিস নামে একজনসহ জমি বিক্রির মধ্যস্থতাকারীরা বাবু সোনার বাসায় পৌঁছে দেন। নিখোঁজের ১০/১২ দিন আগে বাবু সোনা ভারতে যাওয়ার জন্য ভিসা করেন। চিকিৎসা বা অন্য কোন কাজের জন্য ভিসা করেছিলেন, তা জানা যায়নি। জমি বিক্রির টাকা বাড়িতে ছিল। সেই টাকা হাতিয়ে নিতে বা টাকাকে উছিলা করে কোন জঙ্গী গোষ্ঠী বা জামায়াত-শিবির চক্র বা জমি বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা পরিকল্পিতভাবে বাবু সোনাকে প্রলোভনে ফেলে অপহরণ করেছে কিনা তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার দিন বাবু সোনা সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর একজনের মোটরসাইকেলে চড়ে বেরিয়ে যান। তিনি সম্ভাব্য যে পথগুলো ব্যবহার করেছেন, সেই পথে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। যার মোটরসাইকেলে চড়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন, তার সম্পর্কে তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। অ্যাডভোকেট বাবু সোনার স্ত্রী দীপা ভৌমিক জানান, সকালে বের হওয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবেন বলে তাকে বলে যান। এমন কথা বলার পর পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তির সঙ্গে একটি লাল মোটরসাইকেলে করে তিনি বেরিয়ে যান। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগের উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, বাবু সোনা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি বেশ রহস্যজনক। তিনি আলোচিত আইনজীবী। আবার যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি এটিএম আজাহারুল ইসলামের মামলার সাক্ষী তিনি। এজন্য সার্বিক দিক পর্যালোচনা করেই বিষয়টির তদন্ত চলছে। সেইসঙ্গে তাঁকে উদ্ধারে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত আছে। জঙ্গী বা সন্ত্রাসীরা বা জামায়াত-শিবির চক্র কৌশলে প্রলোভন দেখিয়ে তাকে অপহরণ করেছে কিনা তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে শনিবার দুপুরে রংপুর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ রংপুর জেলা ও মহানগর শাখার শাখার সভাপতি বনমালী পাল বলেন, কোন জঙ্গী সংগঠন এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। কারণ জাপানী নাগরিক হোশি কুনিও এবং মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার রায়ের পর দুই দফায় তাকে জঙ্গীরা প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছিল। ওই ঘটনায় রথীশ ভৌমিক থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। কিন্তু পুলিশ তার নিরাপত্তায় কোন পদক্ষেপ নেয়নি। আগামী নির্বাচনে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে জঙ্গীরা এ ঘটনা ঘটাতে পারে। বাবু সোনাকে জীবিত উদ্ধারের জন্য তিনি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রবিবার নগরীতে মানববন্ধন, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ রংপুর জেলা ও মহানগর শাখার নেতা গৌতম রায়, অজয় প্রসাদ বাবন, লক্ষীণ চন্দ্র, শুভ রঞ্জন দেব, সুব্রত সরকার, বাবলু চন্দ্রসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। একই দাবিতে বিকেলে রংপুর টাউন হল চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রংপুর শাখা। সংবাদ সম্মেলনে থেকে নিখোঁজ আইনজীবীকে দ্রুত জীবিত উদ্ধারের দাবি জানানো হয়।
×