ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

আর মাত্র দেড় লাখকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারলেই রাখাইন রোহিঙ্গামুক্ত

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চলছেই, সর্বশেষ এসেছে ৮৪ জন

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৪ মার্চ ২০১৮

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চলছেই, সর্বশেষ এসেছে ৮৪ জন

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ আগে ছিল সরব, এখন চলছে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নীরব অনুপ্রবেশ। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও ৮৪ রোহিঙ্গার একটি দল টেকনাফে হাবিরপীর উপকূলীয় পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে। অনুপ্রবেশের এ তৎপরতা নিয়ে এখন সরকারী-বেসরকারী কোন মহলের তেমন কোন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার প্রকাশ নেই। মিয়ানমার সরকার তাদের দীর্ঘদিনের প্রণীত নীলনক্সার বাস্তবায়ন ঘটাতে প্রায় শেষ পর্যায়ে। আর মাত্র দেড়লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারলে মিয়ানমার রোহিঙ্গামুক্ত হবে বলে বিভিন্ন মহলে আলোচনায় উঠে এসেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি সে দেশের সরকারী-বেসরকারী এবং এর পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মনোভাব কখনও শতভাগ ইতিবাচক ছিল না। বিশেষ করে উগ্র রাখাইনরা বছরের পর বছর রোহিঙ্গাদের ওপর হামলে পড়েছে। কখনও হত্যা, কখনও আগুনের লেলিহান শিখা আবার কখনও বলপূর্বক বিতাড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশুরা দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে এবং এখনও করছে। রোহিঙ্গাদের সমূলে নিধন ও বিতাড়িত করে মিয়ানমার এখন রয়েছে স্বস্তিতে। আর বারো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ভারে এদেশের গোটা কক্সবাজার অঞ্চল চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার এ পর্যন্ত যাই বলুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে ছলেবলে কৌশলে তারা রোহিঙ্গাদের আর কোনভাবেই সে দেশে প্রবেশাধিকার দিতে অনিচ্ছুক। এ বিষয়ে সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেই বসবাস ছিল লাখ লাখ রোহিঙ্গার। তবে সেখানকার ১৪ প্রদেশের রাজধানী সাবেক রেঙ্গুন পরবর্তীতে ইয়াঙ্গুন হয়ে বর্তমানে নেপিদোতে কিছু প্রভাবশালী রোহিঙ্গা বাস করলেও তাদের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি হয়নি সরকারী বা অন্য কোন বাহিনীর। সেখানকার তিনটি বড় শহর নিয়ে গঠিত মিয়ানমারের একটি প্রদেশ রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চল প্রায় রোহিঙ্গাশূন্য হওয়ার পর্যায়ে বললেই চলে। রয়েছে শুধু সিটওয়েতে (সাবেক আকিয়াব) সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা। কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা, যারা দেশটির সরকারের পক্ষে সাফাই গাইবে, এ ধরনের প্রায় ৭৯ হাজার রোহিঙ্গাকে রাখা হয়েছে মংডু এবং বুচিদং-রাচিদং এলাকায়। সিটওয়েতে বসবাস রয়েছে লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গার। সেখান থেকে সহজে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা সম্ভব নয় বলেই সেসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়নি। তবে সেখানকার রোহিঙ্গার ওপর যে অত্যাচার চলছে না, তা নয়। গত বছরের সেপ্টেম্বরে মংডুর সঙ্গে একই সময়ে আকিয়াবেও রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার শুরু হলে সেখান থেকে সরাসরি টেকনাফ পয়েন্ট দিয়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি অনেকাংশে শান্ত হলে রয়ে যায় লাখখানেক রোহিঙ্গা। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, বর্তমানে রাখাইনে থাকা প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে পারলেই রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে পড়বে। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গা ফেরতের শর্তে চুক্তি সই করেছে। চুক্তির পরবর্তী দুই মাসের ভেতর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও চার মাসেও তা হয়নি। বরং চার মাসে আরও অন্তত ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৪ লাখ। তার মধ্যে ওই বছর বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে দেড় লাখ। দেশটির সামরিক বাহিনী ২০১৬ সালে রাখাইনে ৭ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ছিল বলে পরিসংখ্যান দিয়ে উল্লেখ করেছিল। ২০১৭ সালে ৯ অক্টোবরের পর পালিয়ে এসেছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হিসাব মতে ৮৪ হাজার। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। অন্তত দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে এখনও বসবাস করছে। ওসব রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করতে পারলেই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বসতির অবসান ঘটবে। সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার একাধিক সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, মিয়ানমার সকল রোহিঙ্গাকে ঠেলে দেবে না। কেননা, তারা আন্তর্জাতিক মহলকে দেখানো ও বোঝানোর চেষ্টা করবে যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালানো হলে কেন ওসব রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাই কিছু রোহিঙ্গাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে এবং তাদের পক্ষে সাফাই গাইতে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গার বসবাস মিয়ানমারের দরকার। সূত্র জানায়, মিয়ানমার চাপের মুখে রোহিঙ্গা ফেরতে চুক্তিতে সই করলেও রোহিঙ্গা ফেরত নিতে চরম গড়িমসি করছে। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি মতে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা ছাড়াও ৮ হাজার ৩২ জনের স্থলে ৩৭৪ জনের নামের তালিকাও পাঠিয়েছে। এরমধ্যে মিয়ানমার চালাকি করেছে। আগে আরও রোহিঙ্গা ঠেলে দিয়ে আস্তে আস্তে কিছু রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার পাঁয়তারা করছে বলেই প্রতীয়মান। ২০১৬ সালে সাড়ে ১৪ লাখ রোহিঙ্গার স্থলে মিয়ানমার ৭ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ছিল বলে উল্লেখ করার পেছনে রহস্য রয়েছে। হয়ত ওই সময় থেকে তাদের পরিকল্পনা ছিল যে বাংলাদেশে সকল রোহিঙ্গাকে ঠেলে দেবে। আন্তর্জাতিক মহলে কথা উঠলে তারা যেন বলতে পারে ১৪ লাখ রোহিঙ্গা তাদের দেশে কখনও ছিল না। ১৪ লাখের স্থলে যাতে ৭ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে কথা উত্থাপন করা যায় সে নীলনক্সাই তারা রচনা করেছে। এদিকে, প্রায় সাত মাস ধরে অন্তত ১২লাখের বেশি রোহিঙ্গার চাপে স্থানীয়দের নাভিশ্বাস উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাবে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। উখিয়া- টেকনাফে রোহিঙ্গাদের দখলে চলে গেছে কৃষি-অকৃষি হাজার হাজার একর জমি। গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি। এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চাহিদা বেশি থাকায় সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। সেখানে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা ক্রেতার মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়। স্থানীয়রা নিজের শ্রম ও ব্যবসায় কামাই করে কিনছে। আর রোহিঙ্গারা ত্রাণ বিক্রি ও সাহায্য হিসেবে পাওয়া নগদ টাকায় কিনছে ওসব পণ্য। চুরি-ডাকাতিসহ অনৈতিক বিভিন্ন কর্মকা-ে নানা কারণে রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয়দের ক্ষোভ বাড়ছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট ধীরে ধীরে স্থানীয়দের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে দাবি করে পালংখালি ইউপি চেয়ারম্যান গফুরউদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা স্থানীয় শ্রমবাজারে ঝড় তুলেছে। স্থানীয়দের আয়ের উৎস কমে গেছে। কৃষিজমি বিলুপ্ত হওয়ায় আমরা ফসল ও সবজি কম ফলাতে পারছি। গরু-বাছুরকে ঘাস খাওয়ানোরও জায়গা নেই। পালিয়ে আসা এ বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গা কবে মিয়ানমারে ফিরে যাবে, বা আদৌ ফিরতে রাজি কিনা, সে নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রথম দফায় দেয়া আট হাজার ৩২ রোহিঙ্গার তালিকা থেকে মাত্র ৩৭৪ জনকে রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা বলে স্বীকার করে সাত হাজার ৬৫৮ জনেরই তথ্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। আশ্রিত বিপুল রোহিঙ্গার চাপ পড়েছে দুই উপজেলার পাহাড়, ভূমি, বন, বাজারসহ সবখানে।
×