ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয় ফুলের বাগানে দাফন করা হয় প্রিয়ক ও তার কন্যা প্রিয়ন্ময়ীকে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২১ মার্চ ২০১৮

প্রিয় ফুলের বাগানে দাফন করা হয় প্রিয়ক ও তার কন্যা প্রিয়ন্ময়ীকে

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ নেপালে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনার শোক কাটেনি। ঘরে ঘরে এখনও কান্নার রোল। নিহতদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই বাকরুদ্ধ। সোমবার নেপাল থেকে কফিনবন্দী হয়ে ২৩ বাংলাদেশীর লাশ দেশে ফিরে এলে সমস্ত রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে অশ্রুসিক্ত পরিবারের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। মঙ্গলবার নিহতদের নিজ নিজ গ্রামে লাশ দাফন করার সময় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। গাজীপুর শ্রীপুরের বাসার সামনে নিজের প্রিয় ফুলের বাগানে দাফন করা হয়েছে প্রিয়ক ও তার শিশু কন্যা প্রিয়ন্ময়ীকে। শরীয়তপুরের ডামুড্যায় স্মৃতিময় কলেজ মাঠে সাংবাদিক ফয়সাল আহম্মেদের নামাজে জানায় শত শত লোকের জমায়েত হয়। এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তার পরিবার ও স্বজনেরা, বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তার পিতা-মাতা। ফরিদপুরে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় নিহত এসএম মাহমুদুর রহমান ওরফে রিমনের লাশ। মানিকগঞ্জে সমাহিত করা হয়েছে তাহিরা তানভীর শশীকে। শশীর স্বামী ডাঃ শাওন এখনও জানেন না তার স্ত্রী আর নেই। একই দুর্ঘটনায় আহত ডাঃ শাওন বর্তমানে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। রাজশাহীতে চিরশায়িত হলেন একই দুর্ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী আক্তারা বেগম। প্রতিটি লাশ দাফনের সময় ওইসব এলাকায় শোকার্ত মানুষের কান্নায় বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের পাঠানো। গাজীপুরের শ্রীপুরে বাসার সামনে বেলকুনির পাশে নিজের প্রিয় ফুলের বাগানে পাশাপাশি কবরে মঙ্গলবার দাফন করা হয়েছে নেপালে ইউএস বাংলা বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত এফ এইচ প্রিয়ক ওরফে ফারুক হোসেন ও তার শিশু কন্যা প্রিয়ন্ময়ী তামারাকে। তাদের জানাজায় অংশ নিতে আশপাশের গ্রামগুলোসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষের ঢল নামে। নিহত প্রিয়কের চাচাত ভাই লুৎফর রহমান জানান, শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামের ফারুক হোসেন প্রিয়ক ও তার শিশু সন্তান প্রিয়ন্ময়ী তামারার জানাজা মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে স্থানীয় আবদুল আউয়াল কলেজ মাঠে ও বেলা ১১টার জৈনাবাজার এলাকার মাদবরবাড়ি মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। এ কলেজেই প্রিয়ক লেখাপড়া করেছেন। জানাজার আগে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিবেদনের জন্য সকাল ৮টার দিকে ওই কলেজের শহীদ মিনার পাদদেশে নিহতদের কফিন রাখা হয়। এ সময় প্রিয়কের সহপাঠী, বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনসহ এলাকাবাসী তাদের শ্রদ্ধা জানান। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আক্তারসহ স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। জানাজায় আশপাশের গ্রামগুলোসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়। জানাজা শেষে তাদের লাশ নগর হাওলা গ্রামে প্রিয়কের বাসায় এনে শেষবারের মতো স্বজনদের দেখানো হয়। এ সময় স্বামী-সন্তানের লাশের পাশে প্রিয়কের স্ত্রী এ্যানিসহ স্বজনরা বুক ফাটা আহাজারী করতে থাকে। স্বজনদের আহাজারীতে এক হৃদয় বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পরে প্রিয়কের মায়ের ইচ্ছানুযায়ী গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামে প্রিয়কের বাসার সামনে বেলকুনির পাশে প্রিয়কের প্রিয় ফুলের বাগানে ডালিম গাছের পাশে প্রিয়ক ও তার শিশু কন্যাকে পাশাপাশি কবরে দাফন করা হয়। এ বাগান ও বাসাটি প্রিয়কের বেশ প্রিয় ছিল। স্বামী সন্তান হারা প্রিয়কের মা ফিরোজা বেগমের ইচ্ছে, বাসার বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে যাতে জীবনের বাকিটা সময় ছেলে ও নাতনির কবর দেখে ও দোয়া করে সময় কাটাতে পারেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী পারিবারিক গোরস্থানে ইতোপূর্বে দাফনকৃত প্রিয়কের বাবার কবরটিও শীঘ্রই এখানে স্থানান্তর করা হবে। এছাড়াও প্রিয়কের নির্মিত তিনতলা ভবনের এ বাসার নিচ তলায় বসার কক্ষটিকে একটি মিউজিয়াম করা হবে। যেখানে প্রিয়কের বিভিন্ন শিল্পকর্মসহ তার স্মৃতি বিজড়িত জিনিসগুলো রাখা হবে। একই দুর্ঘটনায় প্রিয়কের স্ত্রী এ্যালমুন নাহার এ্যানি এবং প্রিয়কের মামাত ভাই স্থানীয় ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান ও মেহেদীর স্ত্রী সাঈদা কামরুন নাহার স্বর্ণা আহত হন। নিহত এফ এইচ প্রিয়ক ওরফে ফারুক হোসেন ও তার শিশু কন্যা প্রিয়ন্ময়ী তামারার লাশ সোমবার রাত ৮টার দিকে দুইটি পৃথক কফিনে বন্দী করে একটি এ্যাম্বুলেন্সে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামে প্রিয়কের বাসায় আনা হয়। নিহতদের লাশ বাড়িতে পৌঁছার খবর পেয়ে তাদের স্বজন ও এলাকাবাসী প্রিয়কদের বাড়িতে ভিড় জমায়। এ সময় অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এর আগে স্বামী-সন্তানকে শেষ বিদায় জানাতে দুপুরে প্রিয়কের আহত স্ত্রী এ্যালমুন নাহার এ্যানিকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে অপর একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি নিয়ে আসেন স্বজনরা। দুর্ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর এদিনই প্রথমবারের মতো স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর সংবাদটি এ্যানিকে জানানো হয়। এ সময় এ্যানি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি বারবার মূর্ছা যেতে থাকেন। স্বজনরা তাকে সান্ত¡না দেয়া চেষ্টা করে। কিন্তু সান্ত¡না দেয়ার ভাষাও তারা হারিয়ে ফেলেন। অপরদিকে পুত্র শোকে প্রিয়কের মা ফিরোজা বেগম অনেকটা পাথর হয়ে গেছেন। মাঝেমধ্যেই তিনি ছেলে ও নাতনির কফিনের পাশে গিয়ে বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন। এ্যানি ও প্রিয়কের মায়ের আহাজারিতে পুরো এলাকার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। দাফন কার্যক্রম শেষে এ্যানিকে চিকিৎসার জন্য পুনরায় হাসপাতালে ফেরত নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়। বুধবার তাকে হাসপাতালে নেয়ার কথা রয়েছে। ডিএমসিএইচ’র বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান, বিমান দুর্ঘটনায় আহত এ্যানিকে নেপালের কাঠমা-ুর হাসপাতালে চারদিন চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে গত শুক্রবার তাকে দেশে এনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তিনি মানসিকভাবে যেন ভেঙ্গে না পড়েন সেজন্য স্বামী-সন্তানের মৃত্যুর খবরটি জানানো হয়নি। নিহত স্বামী ও সন্তানের লাশ সোমবার দেশে আনা হলে তাদের মৃত্যুর সংবাদ জানানোর জন্য স্বজনরা এ্যানিকে বাড়িতে নিয়ে যান। তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয়েছে। এ্যানির ডান গোড়ালিতে ব্যথা রয়েছে, কিন্তু হাড় ভাঙ্গেনি, লিগামেন্টে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তিনি এখন মোটামুটি ভাল আছেন। তবে যেহেতু তার স্বামী ও সন্তান মারা গেছে, তাই তার মানসিক অবস্থা কেমন, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। হাসপাতালে তিনি বারবার তার মেয়ের খোঁজ করছিলেন। প্রিয়কের চাচাত ভাই লুৎফুর রহমানসহ স্বজনরা আরও জানান, পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতটি দেখা ও বিদেশ ভ্রমণের জন্য গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগর হাওলা গ্রামের আলোকচিত্রী এফএইচ প্রিয়ক ওরফে ফারুক হোসেন তার তিন বছরের একমাত্র সন্তান প্রিয়ন্ময়ী তামারা ও স্ত্রী এ্যালমুন নাহার এ্যানিকে নিয়ে ইউএস বাংলার উড়োজাহাজে চড়ে গত ১২ মার্চ নেপালের উদ্দেশে রওনা হন। একই বিমানে চড়ে ফারুকের মামাত ভাই ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান অমিত ও অমিতের স্ত্রী সাঈদা কামরুন্নাহার স্বর্ণাও বেড়াতে নেপাল যাচ্ছিলেন। তাদের পাঁচ দিনের সফর শেষ করে গত শুক্রবার দেশে ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু তাদের সেই আনন্দ সফর পরিণত হয়েছে বিষাদে। সোমবার (১২ মার্চ) বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নেপালেই নিহত হন ফারুক ও তার মেয়ে প্রিয়ন্ময়ী। অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যাওয়া এ্যানি, মেহেদী ও স্বর্ণাকে আহতাবস্থায় উদ্ধার করে নেপালের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চারদিন চিকিৎসার পর গত শুক্রবার প্রিয়কের স্ত্রী এ্যানি, মেহেদী ও মেহেদীর স্ত্রী স্বর্ণাকে নেপালের হাসপাতাল থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তবে জীবিত ফিরে আসেনি প্রিয়ক ও তার শিশু কন্যা প্রিয়ন্ময়ী। শরীয়তপুর ॥ মঙ্গলবার সকালে নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত সাংবাদিক ফয়সাল আহম্মেদের লাশ শরীয়তপুরের ডামুড্যা পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের তার নিজ গ্রামের সর্দার গার্ডেন বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। সকাল ১১টায় ডামুড্যা কলেজ মাঠে নিহত ফয়সালের জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়েছে। এদিকে তার লাশ একনজর দেখতে শত শত লোক ভিড় জমায় গ্রামের বাড়িতে। সাংবাদিক ফয়সালের লাশ মঙ্গলবার সকালে নিজ বাড়িতে আসবে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে সকাল থেকেই পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের তার গ্রামের বাড়িতে শত শত লোক ভিড় জমায়। লাশবাহী গাড়ি গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে তার পিতা মাতা আত্মীয়-স্বজন ফয়সালের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন, আহাজারি করেন তারা। ফয়সালের বিভিন্ন স্মৃতি উল্লেখ করে বিলাপ করতে করতে সংজ্ঞা হারায় তার পিতা-মাতা। আগুনে পুড়ে মুখম-ল বিকৃত হয়ে যাওয়ায় বঙ্খুলে লাশ দেখানো হয়নি কাউকে। এ সময় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ নিহত ফয়সালের পিতা-মাতাকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করেন। এর আগে নিহত সাংবাদিক ফয়সালের বাড়িতে তার স্বজনদের সান্ত¡না দিতে আসেন শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য বিএম মোজাম্মেল হক, শরীয়তপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক অনল কুমার দেসহ বিভিন্নœ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। সাংবাদিক ফয়সালের অকাল মৃত্যুতে শরীয়তপুরের ডামুড্যা পৌরসভার তার গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন তার পিতা সামসুদ্দিন সরদার। পরিবারের সদস্যরা ফয়সালের মৃত্যুকে যেন কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। শরীয়তপুরের ডামুড্যা পৌরসভার সামসুদ্দিন সরদার ও মোসাম্মৎ সামসুন্নাহার বেগমের বড় ছেলে ফয়সাল আহমেদ (২৯)। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্য সে দ্বিতীয়। ২০০৪ সালে ডামুড্যা মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর ঢাকা তিতুমীর কলেজে এইচএসসি এবং স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অনার্স সম্পন্ন করে ফয়সাল। ব্যক্তিজীবনে অবিবাহিত ফয়সাল বৈশাখি টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ঢাকার ধানম-ি ১৫ নম্বরে বড় বোন শিউলী আক্তারের বাসায় থাকতেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে খুব কম আসতো ফয়সাল। নেপালে ঘুরতে যাওয়ার কথা কাউকে বলেনি ফয়সাল। অফিস, বাসা, আত্মীয় স্বজন কাউকে না জানিয়েই নেপাল গিয়েছিল ফয়সাল। ঢাকায় বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বড় বোন শিউলীকে বলেছিল ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। এটাই পরিবারের কারো সাথে ফয়সালের শেষ কথা ছিল। সর্বশেষ গত ৮/৯ মাস আগে পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে শরীয়তপুর এসেছিল সে। অফিস থেকে ৫ দিনের ছুটি নিলেও নেপাল যাওয়ার বিষয়ে অফিসকে অবহিত করেনি। পরিবারের কেউ জানে না ফয়সাল নেপাল গিয়েছে। মায়ের হাতে রান্না করা গরুর মাংসের খিচুড়ি খুবই পছন্দ ছিল ফয়সালের। মা সামসুন্নাহার বেগম মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে পেলে সেই খিচুড়ির কথা মনে করেই আহাজারি করছেন। ফয়সালের বাবা সামসুদ্দিন সরদার কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, কোন কিছু বলার ভাষা নাই আমার। ফরিদপুর ॥ এসএম মাহমুদুর রহমান ওরফে রিমনের (৩০) দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১০টার দিকে নগরকান্দার লস্করদিয়া ইউনিয়নের লস্করদিয়া গ্রামের পারিবারিক কবরাস্থানে তাকে দাফন করা হয়। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে লাশবাহী একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে মাহমুদুরকে লস্করদিয়া ইউনিয়নের লস্করদিয়া গ্রামে আনা হয়। সেই বাড়ির উঠনে এসে থামে লাশবাহী গাড়ি। রানার গ্রুপে চাকরি পাওয়ার পর বাড়িতে একটি একতলা পাকা ভবনের কাজ শুরু করেছিলেন মাহমুদুর। তিন বছর আগে কাজ শুরু করলেও কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। অসম্পূর্ণ সেই ভবনে বসবাস করেন মাহমুদুরের মা লিলি বেগম, বাবা এসএম মসিউর রহমান এবং ছোট ভাই এসএম মোকলেসুর রহমান। মাহমুদুরের পাঠানো টাকায় সংসার চলত এই তিনজনের। মঙ্গলবার মাহমুদুরের স্ত্রী সনজিদাও এসেছিলেন। নিঃসন্তান সনজিদা স্বামীর সঙ্গে থাকতেন ঢাকার নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকার ভাড়া বাড়িতে। মাহমুদুরের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসার পর এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতরণা হয়। মাহমুদুরের মা লিলি বেগমের চিৎকার ও আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। একমাত্র অবলম্বন সন্তানকে হারিয়ে দুঃখ, কষ্ট ও বেদনার পাশাপাশি তাদের অনিশ্চিত আগামীর কথাগুলিও বার বার ধ্বনিত হতে থাকে তার বিলাপে। বাড়ির একটি ঘরে বসে অর্তনাদ করছিলেন মা। পাশেই বসে ছিলেন বাবা মসিউর রহমান। পাশের একটি কক্ষে নীরবে বসেছিলেন স্ত্রী সনজিদা। নগরকান্দা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ শাহীনুজ্জামান ও নগরকান্দা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ বদরুদ্দোজা মাহমুদুরের বাড়িতে আসেন। সকাল নয়টার দিকে ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়া আসেন মাহমুদুরের বাড়িতে। তিনি মাহমুদুরের মা, বাবা, স্ত্রীসহ স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫০ হাজারসহ নগদ মোট এক লাখ টাকা তুলে দেন তিনি মাহমুদুরের মায়ের হাতে। বেলা ১০টার দিকে লস্করদিয়া আতিয়ার রহমান উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গণে মাহমুদুরের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা পড়ান স্থানীয় লস্কদিয়া মিয়াবাড়ী জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা কামরুজ্জমান। এখানে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউএনও ছাড়াও মাহমুদুরের চাচা শাহ্ মোঃ মসিউর রহমান বক্তব্য রাখেন। জানাজা শেষে লস্করদিয়া গ্রামের পারিবারিক কবরাস্থানে কবর দেয়া হয় মাহমুদুরকে। মাহমুদুর রহমানের চাচা শাহ্ মোঃ মসিউর রহমান বলেন, সর্বশেষ গত দুই মাস আগে সে বাড়ি এসেছিল। তিনি জানান, মাহমুদুর ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার উপার্জনে সংসার চলত। ওই পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই। সংসার চলবে কীভাবে কে জানে? মানিকগঞ্জ ॥ নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত তাহিরা তানভীন শশীকে নিয়ে আসা হয়ে তার পৈত্রিক বাড়ি মানিকগঞ্জ শহরের লঞ্চঘাট এলাকায়। শশীর ৭তম বিবাহ বার্ষিকী পালন করতে গত ১২ মার্চ জীবন সঙ্গিনী ডাঃ রেজওয়ানুল হক শাওনকে নিয়ে হিমালয় কন্যা নেপালের ত্রিভুবন বিমান বন্দরের মাটিতে পা রাখার আগেই বিমান দুর্ঘটনায় শশী নিহত হয়। আর মারাত্বক আহত হন শশীর স্বামী ডাঃ শাওন। তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে একটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত এ্যাম্বুলেন্সে করে শশীর মরদেহ মানিকগঞ্জে আনার পরে শশীর বাড়িতে এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। শত শত মানুষ শশীর বাবা মাকে সান্ত¡না দিতে ভিড় জমায়। সেই সঙ্গে তাদের চিরচেনা শশীকে একনজর দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকে। মানিকগঞ্জের পরিচিত ডাঃ রেজা হাসান আর কামরুন নাহার বেলীর একমাত্র সন্তান তাহিরা তানভীন শশী। স্বজনদের খুব আদরের ছিলো শশী। মমতাময়ী মা কামরুন্নাহার বেলী আর বাবা ডাঃ রেজা হাসান তার এক মাত্র সন্তানের অকাল প্রয়াণে শোকে পাথর হয়ে গেছে। শশীর কফিনটি যখন সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয় তখন শশীর কফিন ধরে তার স্বজনদের কান্নার রোল পড়ে যায়। শুধু স্বজন নয় শশীকে দেখতে আসা প্রতিবেশী সবার চোখ বেয়ে জল পড়েছে। শশী পরপারে চলে যাওয়ায় যখন তার নিকটতম আত্মীয় স্বজনসহ প্রতিবেশীরা শোকে মুহ্যমান ঠিক তখন শশীর স্বামী ডাঃ শাওন সিঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালে মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় ভর্তি। তবে নির্মম বিষয়টি স্বামী ডাঃ শাওন এখনও জানেন না তার জীবন সঙ্গিনী শশীকে আর কোন দিনই দেখতে পারবে না। তাকে স্ত্রী প্রয়াণের বিষয়টি এখনও জানানো হয়নি। শশীর মামা আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুল ইসলাম পুলক জানালেন, শশীর স্বামীর শাররিক অবস্থা আশঙ্কামুক্ত না থাকায় ডাক্তারের পরামর্শে শশীর মৃত্যুর বিষয়টি তার স্বামী ডাঃ শাওনকে জানানো হয়নি। শশীর বাবার শহরের লঞ্চঘাট এলাকার তিনতলার বাড়িটি শোকের বাড়িতে পরিণত হয়েছে। শশীর মামা পুলক আরও জানান, অনেক সাধনার ধন শশী। অর্থাৎ তার বোন কামরুন নাহার বেলীর বিয়ের দীর্ঘদিন পরে শশী তাদের কোল জুড়ে আসে। তাদের জীবনের চেয়ে শশীকে সবচেয়ে বেশি ভাল বাসতেন। কিন্তু এখন তারা কাকে নিয়ে থাকবেন । এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। জোহরের নামজের আগেই শশীর মরদেহ নেয়া হয় মানিকগঞ্জ সরকারী দেবেন্দ্র কলেজ মাঠ সংলগ্ন মসজিদ প্রাঙ্গণে। জোহরের নামজের পর সেখানে শশীর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় জানাজায় উপস্থিত ছিলেন শশীর বাবা ডাঃ রেজা হাসান, জেলা প্রশাসক নাজমুস সাদাত সেলিম, জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান গোলাম মহিউদ্দিন, শশীর আত্মীয় স্বজন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সংবাদকর্মীসহ নানা শ্রেণী পেশার শতশত মানুষ। জানাজা শেষে শশীর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর স্থানীয় সেওতা কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। রাজশাহী ॥ মঙ্গলবার সকালে মহানগরীর গোরহাঙ্গা কবরস্থান মসজিদের পাশে চির নিদ্রায় শায়িত হন নিহত আক্তারা বেগম। তিনি উপশহর এলাকার নজরুল ইসলামের স্ত্রী। এ দুর্ঘটনায় নজরুল ইসলামও নিহত হয়েছেন। তবে তার লাশ এখনও দেশে আসেনি। আক্তারা বেগমের লাশ ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর সকালে মরদেহ রাজশাহী আনা হয়। সকাল ৯টা ২০ মিনিটে তার লাশ নগরীল উপশহর ক্রীড়া সংঘের মঠে পৌঁছায়। এখানে তার শেষ জানাজার নামাজে মানুষের ঢল নামে। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এতে অংশ নেন। এ সময় শোকাবহ হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ। স্বজনদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে। সবাই কফিন ছুঁয়ে শেষ বিদায় জানান তাকে। জানাজার নামাজে রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, রাজশাহী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার, মহানগর ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি লিয়াকত আলী লিকুসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ উপস্থিত ছিলেন। আখতারা বেগমের জামাতা এ্যাডভোকেট ইমরান আলী বলেন, তার শাশুড়ির লাশ দেশে এলেও শ্বশুর নজরুল ইসলামের লাশ শনাক্ত হাওয়া নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। তাই প্রথম দফায় লাশ পাঠায়নি নেপাল। কবে পাঠাবে তাও নিশ্চিত নন। লাশ দ্রুত দেশে আনার জন্য রাষ্ট্রের সহযোগিতা কামনা করেন ইমরান আলী। প্রসঙ্গত, নেপালে বিমান দুর্ঘটনায় রাজশাহীর তিন দম্পতিসহ মোট সাতজন ছিলেন। এদের মধ্যে ছয়জনই নিহত হয়েছেন। নিহত ছয়জনের মধ্যে সোমবার পাঁচজনের লাশ দেশে আসে। এর মধ্যে কেবল আক্তারা বেগমের লাশ দাফনের জন্য রাজশাহী নিয়ে যাওয়া হয়। বাকি চারজনের মধ্যে তিনজনের লাশ ঢাকার শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। রাজশাহীর নওদাপাড়া এলাকার গোলাম কিবরিয়ার নিউইয়র্ক প্রবাসী মেয়ে বিলকিস আরা মিতু, শিরোইল এলাকার বেগম হুরুন নাহার ওরফে বিলকিস বানু ও তার স্বামী হাসান ইমামকে ঢাকায় দাফন করা হয়েছে। আর রুয়েট শিক্ষক এমরানা কবির হাসির স্বামী রকিবুল হাসানের মরদেহ দাফন করা হয়েছে তার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামে। শিক্ষক হাসিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেপাল থেকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
×