ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফয়জুরের বাবা-মা মামা রিমান্ড শেষে কারাগারে

মেজর জিয়াই জাফর ইকবালকে হত্যার নির্দেশদাতা!

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ১৬ মার্চ ২০১৮

মেজর জিয়াই জাফর ইকবালকে হত্যার নির্দেশদাতা!

শংকর কুমার দে ॥ বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যা চেষ্টাকারী ফয়জুরের নির্দেশদাতা হিসেবে তদন্তকারীদের সন্দেহের তীর এখন সেনা বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়ার দিকেই। পলাতক মেজর জিয়ার বাড়ি সিলেটে এবং জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে জাফর ইকবালকে হত্যার জন্য ফয়জুরকে হামলার নির্দেশ দেয়া হতে পারে বলে মনে করছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। মেজর জিয়ার জঙ্গী সংগঠনটিই তার নেতৃত্বে গত কয়েক বছর ধরে প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশকসহ মুক্তমনাদের ইসলামের শত্রু চিহ্নিত করে কুপিয়ে হত্যা করে আসায় এখন তদন্তকারীদের কাছে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’। এ দিকে হামলাকারী ফয়জুর ওরফে ফয়জুল হাসানের বাবা শফিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম ও মামা ফজলুল হককে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ফয়জুল হাসানের বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। হামলাকারী ফয়জুল হাসান ও তার ভাই এনামুল হাসানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে। তাদেরকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে এবং জঙ্গী তৎপরতার সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি তদন্ত কর্তৃপক্ষের। জাফর ইকবালকে হত্যা চেষ্টা রহস্য উম্মোচনের তদন্ত করছে পুলিশের পাশাপাশি, র‌্যাব, সিআইডি, পিবিআই এবং ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, মেজর জিয়ার পুরো নাম সৈয়দ জিয়াউল হক। তার বাবা সৈয়দ জিল্লুল হক। তাদের বাড়ি সিলেটের মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুর গ্রামে। ২০১২ সালে বাংলাদেশে এক ‘ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান’ চেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে চাকরি হারান মেজর জিয়া। চাকরি হারানোর পর থেকেই তিনি আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের (এবিটি) সামরিক কমান্ডারের দায়িত্ব নেন জিয়া। সামরিক প্রশিক্ষণ দেন অন্তত দু’শতাধিক সদস্যকে। পরবর্তীতে এই প্রশিক্ষিত সদস্যদের মাধ্যমে লেখক-প্রকাশক, ব্লগার ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের হত্যার টার্গেট সেট করে কিলিং মিশন পরিচালনা করেন এমন তথ্যও রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে। অধ্যাপক জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় এবার মোস্টওয়ান্টেড হিসেবে খোঁজা হচ্ছে প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ড পুলিশের ২০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষিত সেনা বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান পলাতক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়াকে। মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক বাংলাদেশী বংশদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে খুন করার সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে এই জঙ্গী নেতা হত্যাকান্ডের তদারকি করেছে বলে তদন্তে চলে আসায় এখন গ্রেফতারের তালিকায় অগ্রাধিকার পেয়েছে তার নামটি। দেশের ভেতরে বিগত কয়েক বছরে যত প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার খুনের ঘটনা ঘটেছে তার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়া। বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় দুটি জঙ্গী সংঠনের একটি আনসার আল ইসলাম, যার শীর্ষ নেতা বহিষ্কৃত মেজর জিয়াকে ধরতে পারা পুলিশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার নেতৃত্বেই এখন আনসার আল ইসলাম সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। নব্য জেএমবিসহ অন্য জঙ্গী সংগঠনগুলোর মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়ার পর অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আনসার আল ইসলাম এবং মেজর জিয়াই বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য জিয়াকে ধরা তাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মাস্টারমাইন্ড জঙ্গী মেজর জিয়া এখন কোথায় এ প্রশ্নের জবাব পেতে মরিয়া গোয়েন্দা সংস্থা ও দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গত বছরের ২ আগস্ট তাকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করার সময় তার অবস্থান দেশেই ছিল বলে মনে করেন তদন্তকারীরা। ওই সময় তার গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকার কথা প্রচার পেলেও পরবর্তীতে তার অবস্থান সম্পর্কে কারও কাছে কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন আবার সে ঢাকায় অবস্থান করছে বলে এমন তথ্যের ভিত্তিতে তার অবস্থান শনাক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে গোয়েন্দারা। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী এই সংগঠনটির বেশির ভাগ সদস্যই উচ্চশিক্ষিত এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষভাবে দক্ষ। ফলে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। তদন্ত সূত্র জানায়, ২০১৭ থেকে ১৬ সালের মধ্যবর্তী পর্যন্ত সময়ে মেজর জিয়া স্লিপার সেল তৈরি করে অন্তত এক ডজন ব্লগারকে হত্যা করে। আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের প্রধানেরও দায়িত্ব নেয় মেজর জিয়া। এই মাস্টারমাইন্ড নিজে বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ এবং আর্মি ট্রেনিং থাকায় কিলিং অপারেশন যারা চালাবে-তাদেরকে দেশের বিভিন্ন চরাঞ্চলে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। তার সন্ধানে পুলিশ র‌্যাব গোয়েন্দা ইউনিট একযোগে দেশব্যপী সাড়াশি ও কম্বিং অপরারেশন পরিচালনা করেও ধূর্ত এই সাবেক সেনা কর্মকর্তার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেনি পুলিশ। জঙ্গীবাদ দমনে গঠিত পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট- কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে যে দুটি জঙ্গী গোষ্ঠী বাংলাদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তার একটি আইএস অনুসারী নিও জেএমবি বা নব্য জেএমবি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে আনসার আল ইসলাম এমন পদ্ধতিতে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে, যাতে এই সংগঠনের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে আনা অনেকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ হিসেবে তারা আনসার ইসলামের শীর্ষ নেতা বা সামরিক কমান্ডার জিয়ার ধূর্ত কিছু কৌশলের কথা বলছেন। জিয়া একসময় সেনাবাহিনীর চৌকস একজন কর্মকর্তা ছিল। সামরিক প্রশিক্ষণ এবং নিত্য-নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে সে অনেক বেশি দক্ষ। নিজের দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে সে তার সদস্যদেরও অনেক বেশি দক্ষ করার চেষ্টা করছে। মেজর জিয়া তার নিজের সামরিক প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে সদস্যদের ‘গেরিলা যোদ্ধা’ হিসেবে প্রস্তুত করছে। ট্রেনিংয়ের বিষয়বস্তু হচ্ছে, গেরিলা যুদ্ধের কৌশল, বাসা ভাড়া নেবার কৌশল, বাসায় বসবাসের নিয়ম, নিরাপত্তা কৌশল, কম্পিউটার চালনাসহ ইলমি শিক্ষা। যাদের মূললক্ষ্য হলো ‘টার্গেট কিলিং’, যা এই সংগঠনটি শুরু করেছিল চার বছর আগে ২০১৩ সালে। এই সংগঠনের টার্গেট গ্রুপ হলো ব্লগার, নাস্তিক, সেক্যুলার, রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। এ পর্যন্ত তাদের এই টার্গেট ঠিক থাকলেও ভবিষ্যতে তারা আরও বেশি ধ্বংসাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ছদ্মবেশে মেজর জিয়া ঢাকায় অবস্থান করে থাকতে পারে। তবে সে জঙ্গী নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে নিজেকে। এমনকী ব্লগার ও প্রগতিশীল লেখক হত্যাকা- আপাতত বন্ধ রেখে তার অনুসারী জঙ্গীদের আত্মগোপনে থাকার কৌশল নিতে নির্দেশ দিয়েছে এমন তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। এই জঙ্গী নেতা ভাল করে জানে-জঙ্গী নেটওয়ার্ক সচল করার সঙ্গে সঙ্গে তার ধরা পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর এ ব্যর্থ অভ্যূত্থানের চেষ্টা করার পর সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত হয়ে আত্মগোপনে যান মেজর জিয়া। আত্মগোপনে থেকে জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) আধ্যাত্মিক নেতা শাইখ জসিমউদ্দিন রাহমানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জসিমুদ্দিন রাহমানি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলে মেজর জিয়া আনসারুল্লাহ বাংলাটিম প্রধানের দায়িত্ব নেন। মাস্টারপ্লান করে ব্লগার হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নামেন এই জঙ্গী নেতা। মূলত যারা ইসলাম নিয়ে সমালোচনা করে তাদেরকে বেছে বেছে হত্যা করে সেনা বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়ার নেতৃত্বে জঙ্গী গোষ্ঠীটি। অধ্যাপক জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় ফয়জুল হাসান ও তার সহযোগীদের হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য হামলার নির্দেশ দিয়ে থাকতে পারে মেজর জিয়াই। হামলাকারীর বাবা-মা, মামা কারাগারে ॥ বরেণ্য লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুল হাসানের বাবা শফিকুর রহমান ও ও মামা ফজলুল হককে পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে তাদের বৃহস্পতিবার কারাগারে পাঠান হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তৃতীয় আদালতে হাজির করা হলে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক হরিদাস কুমার। গত ১১ মার্চ এই আদালতে তাদের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে আদালত পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই দিন ফয়জুলের মা মিনারা বেগমের দুই দিন রিমান্ড মঞ্জুর হলে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত ১৩ মার্চ কারাগারে পাঠান হয়। গত ০৮ মার্চ হামলাকারী ফয়জুলের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ওই আদালতের বিচারক। বর্তমানে ফয়জুলের ভাই এনামুল হাসানও পুলিশি রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
×