ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না বাজারে ছেড়েও

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাড়ছে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না বাজারে ছেড়েও

রহিম শেখ ॥ বাজারে ডলার ছেড়েও দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। হু হু করে বাড়ছে ডলারের দাম। চলতি অর্থবছরের জুলাই শেষে আন্তঃব্যাংক ডলারের দর ছিল ৮০.৬৬ টাকা। গত জানুয়ারি শেষে এই দর বেড়ে হয়েছে ৮২.৯০ টাকা। গত বৃহস্পতিবার ডলার বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৮৫.২৫ টাকায়। এই সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ৩.৭৭ শতাংশ। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে রফতানি ও রেমিটেন্স প্রবাহ কম হওয়ায় ডলার বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে কোন কোন ব্যাংক ডলার ধরে রেখে ব্যবসা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। যদিও এই মুহূর্তে ব্যাংকগুলোর আয়ের একটি বিশেষ অংশই ডলার কেনাবেচা থেকে হচ্ছে। গত বছরের নবেম্বর মাসে ডলার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে তিনটি বিদেশী ও ১৭টি দেশীয় ব্যাংকে সতর্ক করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারপরও থামানো যায়নি ডলারের উচ্চ মূল্য বৃদ্ধি। সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় শ’ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে বিক্রি করেছিল মাত্র ১৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার। বিপরীতে কিনেছিল ১৯৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। গত কয়েক মাসে বাজারে প্রচুর ডলার ছেড়ে দাম ঠিক রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য গত দুই-তিন মাসে দাম ব্যাপকহারে না বাড়লেও ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। এক বছর আগের চেয়ে এখন বেড়েছে প্রায় চার টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, আন্তঃব্যাংক দরের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডলার প্রতি আরও প্রায় দেড় টাকা বেশি রাখছে আমদানি পর্যায়ের গ্রাহকদের কাছ থেকে। গত বৃহস্পতিবার ডলারের আন্তঃ ব্যাংক দর ছিল ৮২.৯২ টাকা। অন্যদিকে আমদানি পর্যায়ে ব্যাংকগুলোর ডলারের দর ছিল সর্বোচ্চ ৮৩.৪০ টাকা। বিদেশী ওরি ব্যাংকের ডলারের দর ছিল আন্তঃব্যাংক দরের থেকেও কম, ৮২.৩৫ টাকা। একই দিন বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছে নগদ ডলার বিক্রি সর্বোচ্চ দর হেঁকেছে ইউনিয়ন ব্যাংক। এই ব্যাংকটির ডলারের দর ছিল ৮৫.২০ টাকা। ওই দিন বেশির ভাগ ব্যাংকেরই নগদ ডলারের দর ছিল ৮৪ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে। সর্বনিম্ন দর ছিল ইস্টার্ন ব্যাংকে, ৮৩ টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া এবং দেশের বৈদেশিক লেনদেনে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় ডলারের চাহিদা বাড়ছে। চাহিদা পূরণ করতে পর্যাপ্ত ডলারের জোগান দিতে গিয়ে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দরে কিছুটা উর্ধমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় গত রবিবার বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়োজিত অনুমোদিত ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সম্প্রতি ডলারের দর বাড়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। সংস্থাটি ডলারের দর যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে বলে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত ডলার কিনে রাখতে নিষেধ করে। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংক এতে হস্তক্ষেপ করবে বলে ব্যাংকগুলোকে জানানো হয়। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে ডলারের দরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করুক তা চায় না বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, ডলারের চাহিদা বাড়লে দাম বাড়বে আর চাহিদা কমলে দাম কমে যাবে। এটাই স্বাভাবিক। তাই ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভাল। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয় বলে তারা মনে করেন। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস এ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান সোনালী ব্যাংকের সিইও ও এমডি মোঃ ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, ডলারের দর বৃদ্ধির প্রধান কারণ আমদানি বৃদ্ধি। ব্যাংকগুলোতে ঋণপত্র খোলার তুলনায় নিষ্পত্তি কম। চাহিদার তুলনায় জোগানের স্বল্পতার কারণে দর বাড়ছে। এটা বাজারের ওপর নির্ভর করে। আমরা বাফেদার পক্ষ থেকে বিদেশী মুদ্রার বাজার প্রতিনিয়ত নজরে রাখছি। সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসেই এলসি খোলার পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বছর শেষে এই অঙ্ক ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমদানি বাড়ার কিছু ক্ষেত্র যেমন বড় উন্নয়ন প্রকল্পের যন্ত্রাংশ উপকরণ আমদানি বেড়েছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২৬ শতাংশ। যেখানে রফতানি আয় বেড়েছে মাত্র ৭.৭৮ শতাংশ। এই সময়ে খাদ্য (চাল ও গম) আমদানি বেড়েছে ২১২ শতাংশ। শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে ৩৫ শতাংশের মতো। জ্বালানি তেলের আমদানি বেড়েছে ২৮ শতাংশ এবং শিল্পের কাঁচামালের আমদানি বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৭৬ কোটি ৭০ লাখ ডলারে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৯গুণ (৯০০ শতাংশ) বেশি। সাধারণত চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হলে দেশকে ঋণ করে ওই ঘাটতি মেটাতে হয়। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহে বর্তমানে বেশ কিছুটা প্রবৃদ্ধির ধারা বিরাজ করছে। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে প্রায় ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে তিন হাজার ২৭৬ কোটি ডলারের বেশি বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। ডলারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ১৫০ কোটির বেশি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকের মতো মানি এক্সচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ডলারের দর বেড়েছে। জানা গেছে, গত সপ্তাহে বিভিন্ন মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক ডলার বিক্রি হয়েছে প্রায় ৮৫ টাকায়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বলেন, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেলসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানিতে অনেক খরচ হচ্ছে। গত বছর বন্যায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যশস্য আমদানি অনেকগুণ বেড়েছে। তা ছাড়া দেশের শিল্পখাতে বিনিয়োগেও কিছুটা গতি এসেছে; কিন্তু সে তুলনায় রফতানি আয় না বাড়ায় ডলারের চাহিদা বেড়ে এর দরকে একটু একটু করে বাড়িয়ে তুলছে। সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, ডলারের এই দাম বৃদ্ধি আমদানি ব্যয় এবং ভোক্তা ব্যয় বাড়াচ্ছে। ডলারের বেশি দামের কারণে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে।
×