ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কর্মসূচীতে সাধারণ মানুষের সাড়া মেলেনি

খালেদার রায় ঘিরে বিএনপির সব তর্জন-গর্জন অসার

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

খালেদার রায় ঘিরে বিএনপির সব তর্জন-গর্জন অসার

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার আগেই বিএনপির সকল তর্জন গর্জন অসাড় হিসাবেই দৃশ্যমান হলো। বৃহস্পতিবার ঘোষিত ওই রায়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া পাঁচ বছরের দন্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে গেছেন। তিনি এখন নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো সেন্ট্রাল জেলের বাসিন্দা। তার জ্যেষ্ঠপুত্র এ পর্যন্ত দুই মামলায় দন্ডিত হয়েছেন। পালিয়ে অবস্থান করছেন সুদূর লন্ডনে। বেগম জিয়ার নির্দেশে এবং দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দন্ডিত ও পলাতক সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বৃহস্পতিবার রাত থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তারেকের পর মা বেগম জিয়াও আর্থিক দুর্নীতির মামলার রায়ে দন্ডিত হয়ে দলের জন্য নানামুখী উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। এদিকে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার দিন ধার্য হওয়ার পর থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে যেভাবে তর্জন গর্জন করা হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে ইতোপূর্বেকার মতো রক্তক্ষয়ী কোন ঘটনা বা প্রাণহানি হয়নি। রায় ঘোষণার দিন ও এর আগে থেকে দেশজুড়ে এক ধরনের টান টান অজানা উত্তেজনা বিরাজ করছিল সর্ব মহলে। বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার আগে ও পরে দেশের প্রধান প্রধান নগরীগুলো এ ধরনের ফাঁকা হয়ে যায়। ঢাকাসহ দুয়েকটি স্থানে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে। মূলত সাধারণ মানুষ বেগম জিয়ার রায় ঘোষণাকে নিয়ে মাঠে না নামায় বিএনপিকে রীতিমতো অসহায়ত্ব বরণ করতে হয়েছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বোদ্ধাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যে মামলায় বেগম জিয়াকে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে তা থেকে উত্তরণ পাওয়ার কোন পথ খোলা ছিল না। এতিমখানার নামে বিদেশ থেকে টাকা এনে তা আত্মসাত করা হয়েছে। অথচ মামলার যুক্তিতর্ক চলাকালে অনুরূপ এতিমখানার কোন অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি বেগম জিয়ার পক্ষের আইনজীবীগণ। সঙ্গত কারণে রায়ে অন্য ৫ জনের মতো তারও দশ বছরের দন্ড হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আদালত বেগম জিয়ার বার্ধক্য এবং মানসম্মানের কথা বিবেচনা করে তাকে মাত্র পাঁচ বছরের দন্ড দিয়েছে। এ আদেশ উচ্চ আদালতে স্থগিত না হওয়া পর্যন্ত বেগম জিয়া বন্দী থাকবেন। ইতোমধ্যে জানা গেছে, তার কারাবাস অন্যান্য সাধারণ আসামি বা কয়েদিদের মতো নয়। তার জন্য করা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। সঙ্গে একজন গৃহকর্মী রাখার সুযোগও পেয়েছেন। আর চিকিৎসা কার্যক্রম চলবে দুবেলা। খাওয়া ধাওয়া তার পছন্দ অনুযায়ী পরিবেশিত হবে। এখানে উল্লেখ করতে হয়, ৯০-এর গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর তাকে তার বাসভবনকে সাবজেল করে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে নির্বাচনে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে এরশাদের কারাবাস ব্যবস্থা এমন কঠোর করা হয় যে, তার নিত্যকার কার্যক্রম সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করে রাখা হতো। এরশাদের কাছে বাহির থেকে যেমন কোন চিঠিপত্র দেয়ার সুযোগ রাখা হতো না, তেমনি ভেতর থেকেও এরশাদ যাতে কাউকে কোন চিরকুট দিতে না পারেন সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করে রাখা হয়েছিল। জেল থেকে বের হওয়ার পর এরশাদ নিজেই বলেছিলেন, কারাবাসকালে তার ওপর মানসিকভাবে নানামুখী নির্যাতন চালানো হয়েছে বছরের পর বছর। এসবই হয়েছে বিএনপি সরকারের নির্দেশে। আর সে সরকারের প্রধান ছিলেন খালেদা জিয়া। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি মামলার রায় মাথায় নিয়ে এখন কারাবাস করতে হচ্ছে। কিন্তু এরশাদের কারাবাস ও বেগম জিয়ার কারাবাসের মধ্যে ব্যাপক তফাৎ রয়েছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, বেগম জিয়ার কারাবাসের প্রক্রিয়া অনেকাংশে রাজকীয়। কেননা, সাধারণ আসামি বা কয়েদিদের সেলে তাকে রাখা হয়নি। তার থাকা ও খাওয়া দাওয়াসহ সব কিছুতেই আলাদা ব্যবস্থা। কারাগারে যাওয়ার পর পরই তার সঙ্গে ভাই বোন দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এরশাদের কারাবাসের সময় এ ধরনের দেখা সাক্ষাত ছিল কঠিন একটি ব্যাপার। বেগম জিয়া দুবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। একবার ছিলেন পনেরো দিনের জন্য প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে। ফলে টিকতে পারেননি। জনরোষে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতাসীনরা বাস্তবতা ভুলে যান। বেগম জিয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তিনি বা তার দল ঘূর্ণাক্ষরেও চিন্তায় আনতে পারেনি বেগম জিয়াকে দন্ডিত হয়ে কারাগারে যেতে হবে। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটেছে। বহু রণহুংকার দেয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষে। সারাদেশ অচল করার হুমকিও ছিল। কিন্তু সবাই ব্যর্থ হয়ে গেল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও সাধারণ মানুষের সমর্থন না মেলার কারণে। এক্ষণে আলোচিত হচ্ছে বিষয়টি বেগম জিয়া ও তার দলকে অনুধাবন করতে হবে দুর্নীতির মামলায় দ-িত হয়ে দলের চেয়ারপার্সনও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পরিণাম কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। বিএনপির সমর্থক এমন অনেকে এখন লজ্জার অতল গহ্বরে তলিয়ে গেছে। যতই বলা হোক না কেন, তারা ন্যায় বিচার পাননি। আসলে কি তাই। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দ-াদেশ দিয়ে কারাগারে প্রেরণ কি এতই সহজ ব্যাপার। এ ঘটনা আগামী দিনের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে। আর এ সত্য অথচ দুঃখ ও লজ্জাজনক ইতিহাসের ঘানি টেনে বিএনপিকে আগামী দিনের পথ পাড়ি দিতে হবে। সে পথ পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যার পর সমস্যার যে মুখোমুখি হতে হবে তা দলটির কারও অজানা নয়। সাধারণ মানুষকে যতই বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হোক না কেনÑ এদেশের মানুষ রাজনীতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন। শিক্ষিত অশিক্ষিত, ধনী-গরিব থেকে শুরু করে এদেশের মানুষ রাজনৈতিক আলোচনায় বলা চলে চ্যাম্পিয়ন। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিত্তশালীদের সুরম্য প্রাসাদেও এমন কোন দিন নেই যে, যেখানে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয় না। রাজনীতির এ আলোচনায় এখন প্রধান আলোচ্য হচ্ছে দুর্নীতির দায় নিয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কারাবরণ। আরও আলোচিত হচ্ছে, তারপুত্র দুই মামলায় দন্ডিত তারেক জিয়াকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব অর্পণ, যিনি কিনা গ্রেফতার এড়াতে বছরের পর বছর বিদেশে পলাতক জীবনে রয়েছেন। রায় ঘোষণার পর তারেক জিয়ার অনুসারীরা যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা ও ভাংচুর চালিয়ে আরেক ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। এ ঘটনাও নতুন একটি রেকর্ড। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে বেগম জিয়ার এ কারাবরণ সারাজীবনের জন্য নয়। মাত্র পাঁচ বছরের দন্ড মাথায় নিয়ে তিনি কারাগারে গেছেন। দলের নেতাকর্মীদের চোখের সামনে। এর আগে বৃহস্পতিবার রায় শোনার জন্য আদালতে গেছেন বিশাল লটবহর নিয়ে। বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকরা এমনকি খোদ খালেদা জিয়া আদালতের রায় মেনে না নিয়ে ভিন্ন কোন ঘটনার জন্ম দেয়ার কোন সুযোগ পাননি। এ সবের মূলে রয়েছে সাধারণ মানুষের সমর্থন না পাওয়া। ফলে তার গন্তব্য হয়েছে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো জেলখানায়। এখন জেলখানা থেকে তিনি কিভাবে দলকে দিক নির্দেশনা দেবেন এবং তার জ্যেষ্ঠপুত্র দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পলাতক তারেক রহমান বিএনপিকে কোন পথে পরিচালনা করবেন তাই এখন দেখার বিষয়। এদিকে আগামী সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এ নির্বাচনে কারও মতে বিএনপি আসবে, আবার কারও মতে বিএনপি আসবে না। রাজনৈতিক অঙ্গণে এ নিয়ে চলছে সরব আলোচনা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, দ-াদেশপ্রাপ্তির বিষয়টি বেগম জিয়া ও তার অনুসারীরা আগেই নিশ্চিত হয়ে যান। ফলে তিনি জনসভা থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে বৈঠক এমনকি সংবাদ সম্মেলনও করে নানা বক্তব্য দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন, যেখানেই থাকি না কেন জনগণের সাথেই থাকব। মূলত তিনি বর্তমানে এমন একটি কারাগারে আছেন যেখানে কোন আসামি বা কয়েদিরাও নেই। বিষয়টি বলা চলে নির্জন একটি স্পট। সঙ্গত কারণে আলোচনা চলছে, অন্যায় অবিচার করে সাময়িক পার পাওয়া যায়। তবে তা পুরো জীবনের জন্য নয়। বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে তাই ঘটল। এদেশের মানুষের অধীর উদ্বেগ উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে বেগম জিয়া দ-িত হলেন, ঢুকলেন কারাগারে। দেশবাসীর রুদ্ধশ্বাসের অবসান ঘটল। মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসল। যদিও আজ বিএনপির পক্ষ থেকে দেশব্যাপী বিক্ষোভ সমাবেশ আহ্বান করা হয়েছে। এ সমাবেশও শুক্রবারের কথিত বিক্ষোভ সমাবেশের চিত্রের মতোই পরিলক্ষিত হবে বলে অভিজ্ঞ ।
×