ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বয়স বাড়লেও কমেনি কাজের গতি

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

বয়স বাড়লেও কমেনি কাজের গতি

গ্রামীণ বাংলার মেয়েদের হাতে শোভা পাওয়া ‘কুশি কাটা’ যখন আধুনিকতা আর উন্নয়ন-অগ্রগতির বদৌলতে হারিয়ে যেতে বসেছে, ঠিক তখন সেই ‘কুশি কাটা’কে আঁকড়ে ধরে আজ স্বাবলম্বীর মডেল হয়ে উঠেছেন শেরপুরের নকলা শহরের গড়েরগাঁও এলাকার আত্মপ্রত্যয়ী নারী মনিরা বেগম চন্দন (৭৫)। বয়স বাড়লেও কমেনি তার কাজের গতি। যে কারণে সুই, সুতা ও কুশি কাঁটার মাধ্যমে তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি পাপোশ, টুপি, শরীর মাজুনি, চুলের খোঁপা বাধুনি, শীতের সোয়েটার, গায়ের চাদর, কার্পেট ও ভ্যানেটি ব্যাগ ছাড়াও ফেলনা কাগজ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি আসবাবপত্রও এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি মাসেই বাড়ছে তার আয়। অন্যদিকে কুশি কাঁটার পণ্যে মনিরার স্বাবলম্বিতার দৃষ্টান্ত দেখে এলাকার অনেক নারীই উৎসাহিত হয়ে এখন ওই কাজের দিকে ঝুঁকছেন। প্রচ- আত্মপ্রত্যয়ী ওই স্বাবলম্বী নারীর পুরো নাম মনিরা বেগম চন্দন হলেও এলাকায় তিনি চন্দন বা ‘মনিরা আপা’ নামেই সমধিক পরিচিত। বৈবাহিক সূত্রে নকলায় তার বসবাস হলেও জন্ম ভারতের মুর্শিদাবাদে নানার বাড়িতে। ১৯৪৫ সালে তার নানা ও বাবার পরিবার বাংলাদেশে এসে রাজশাহীতে বসবাস শুরু করেন। এদেশে আসার পরপরই নকলার আজিজুর রহমানের সঙ্গে কিশোরী বয়সেই তার বিয়ে হয়। বাবা, মা, ৮ বোন ও ৪ ভাইয়ের বিশাল পরিবারই তার বাল্যবিয়ের মূল কারণ। কৈশোরে বিয়ে হলেও তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী। সেই প্রত্যয়ে উজ্জীবিত হয়ে স্মৃতিস্বরূপ তার হাতের পণ্য সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে তিনি সংকল্প করেন। প্রথমেই কুশি কাটার কাজ করে তিনি সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেন। একসময় তার তৈরি পণ্যের সুনাম উপজেলা থেকে জেলার গ-ি পেরিয়ে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এরই ফাঁকে তিনি ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের জননী হন। সংসার গুছিয়ে দিন রাত শুধু একই চিন্তায় মগ্ন থাকেন কিভাবে তার হাতের স্মৃতি সবার ঘরে ঘরে পৌঁছানো যায়। অবশেষে ঠিক করলেন পণ্য তৈরি করে আগে পরিচিতদের বাসায় পৌঁছাবেন। এভাবেই শুরু হলো তার নিপুণ হাতের কাজের প্রচার-প্রসার। আগে বাসায় গিয়ে বিক্রি করলেও এখন আর তা করতে হয় না। বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে ক্রেতারা গিয়ে কিনে নেন তার তৈরি শৌখিন পণ্য। তার তৈরি পণ্য নিজ উপজেলা নকলাসহ শেরপুর, জামালপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নালিতাবাড়ী, ফুলপুর, শ্রীবরদী, হালুয়াঘাট, বকশীগঞ্জ, ঝিনাইগাতি, রাজশাহী ও ঢাকাতেই বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। ওইসব এলাকার ক্রেতা সাধারণ ছাড়াও দূরের পাইকাররা গিয়ে তার তৈরি পণ্য কিনে নিয়ে যান। অনেক সময় পাইকাররা অগ্রিম টাকা দিয়ে অর্ডার দিয়ে যান। তবে তার তৈরি পণ্যগুলো যেহেতু শৌখিন ও ব্যয়সাপেক্ষ, তাই দাম একটু বেশি বলে মনে করেন অনেক ক্রেতা। সরেজমিনে গেলে ৩-৪ জন মহিলা ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম করাবস্থায় কথা হয় মনিরার সঙ্গে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, রাজশাহীতে থাকাকালীন নিজ উদ্যোগে প্রতিবেশীদের কাছে কুশি কাঁটার কাজ শিখেন। নকলায় আসার পর স্বামীর সংসারে ব্যাপক ব্যয়ের চাকা ঘুরাতে সেই কুশি কাঁটাকেই পুঁজি করে নেন তিনি। এরপর থেকেই তিনি ঢাকার মগবাজার ও টঙ্গী হতে বিভিন্ন রং ও সাইজের কুশি, কাঁটা, সুই ও সুতাসহ প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ কিনে এনে এনে চালিয়ে যান তার শৈল্পিক কারুকাজ। এখন তিনি দৈনিক ছোট বা মাঝারি ধরনের ১-২টি পণ্য তৈরি করতে পারেন, যার প্রতিটির দাম ৫শ’ টাকা থেকে ৭শ’ টাকা পর্যন্ত। তিনি জানান, মাসে ১৫ হাজার টাকা করে বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার পণ্য তৈরির উপকরণ কিনে এনে নিয়মিত শ্রম দিলে মাস শেষে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করায় বছরে ৪ লাখ ২০ হাজার থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। তাতে মনিরার মাসে লাভ থাকে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তার দেখাদেখি নকলা উপজেলার অনেক মহিলা ও মেয়ে শিক্ষার্থীরা তাকে অনুসরণ করে কুশি কাটা, ফেলনা কাগজ ও বাঁশের পণ্য তৈরি করার দিকে ঝুঁকছেন। এ বিষয়ে নকলা উপজেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা আরমানা হক বলেন, মহিলাদের সার্বিক উন্নয়ন ও সফলতায় মহিলা ও শিশুবিষয়ক অফিসের দেয়া পরামর্শ ও প্রশিক্ষণের ধারাবাহিকতায় মনিরা আপাকেও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। তিনি বর্তমান যুগের নারীদের সুস্থ ও সফলতার মডেল। - রফিকুল ইসলাম আধার, শেরপুর থেকে
×