ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

সবজি চাষে প্রান্তিক নারীদের অবদান

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮

সবজি চাষে প্রান্তিক নারীদের অবদান

বাংলাদেশে উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান গতিধারায় কৃষি অর্থনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সামগ্রিক অর্থনীতির সিংহভাগই আসে কৃষিজপণ্য থেকে। নদীমাতৃক বাংলার উর্বর ফসলী জমি উৎপাদনে যে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে আসছে সময়ের অনিবার্য গতিতে তা আরও সম্ভাবনাময় অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার চাহিদা মেটাতে কৃষিনির্ভর উৎপাদিত পণ্য বহুমাত্রিক ধারায় এগিয়ে চলেছে। আর এই কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে সবজি চাষ আজ সারাদেশকে কতখানি সমৃদ্ধ করেছে তা সত্যিই উল্লেখ করার মতো। আসলে সাধারণ মানুষের ঘামঝরা পরিশ্রমে পুরো দেশের যে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি সেখানে অর্ধাংশ নারীর প্রান্তিক কৃষকের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সবজি চাষকে বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করেছে। নদী বিধৌত আবহমান বাংলার প্রান্তিক কৃষকরা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উৎপাদনে বিশ্বজোড়া খ্যাতি নিয়ে চতুর্থ স্থান দখল করে আছে। পাশাপাশি বিস্ময়করভাবে সবজি চাষীরা ও বাংলার চিরায়ত ফলনবান্ধব মৃত্তিকায় শাক-সবজির আবাদ করে দেশের চাহিদা মিটিয়েও বিশ্বের তৃতীয়তম আসনে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে। আর এক্ষেত্রে প্রান্তিক নারী চাষীদের ভূমিকা একেবারে শীর্ষ স্থানে। নারী-পুরুষের সমতায় বাংলাদেশ আজ অনেকখানি এগিয়ে। বিশ্বে ৪৭তম হলেও দক্ষিণ-এশিয়ায় একেবারে শীর্ষস্থানে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। কৃষিনির্ভর গ্রাম-বাংলার গৌরবোজ্জ্বল অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে নারীরা বরাবরই নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল। একেবারে ফসলী মাঠে কিংবা ক্ষেতে সেভাবে দৃশ্যমান না থাকলেও গৃহকোণের ছোট্ট আঙ্গিনায় নিজের একটা সীমাবদ্ধ সবজির বাগান থাকত গৃহকর্ত্রীর। আর সেটা ছিল সমৃদ্ধ বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে নিজস্ব চৌহদ্দির মধ্যে এক দৃষ্টিনন্দন সবজির ফলন। ছোট্ট পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে নিকটবর্তী বাজারেও চলে যেত গৃহকোণে উৎপাদিত সেসব শাক-সবজি। আর গৃহকর্তারাই এই বাজার অর্থনীতির ক্ষুদ্র দায়ভাগটুকু পালন করতেন। যা দিয়ে পরিবারের আর্থিক সংস্থান তো হতোই তার চেয়েও বেশি হয়ে যেত নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার এক সহজ সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। সময়ের দুর্বার মিছিলে নারীরা আজ সীমাবদ্ধ আলয়ে আটকে নেই। পরিবর্তিত সামাজিক বলয়ে যুগের দাবি মেটাতে গিয়ে তাদেরকে গ-িবদ্ধ পারিবারিক সীমানা থেকে বের হয়ে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গনে তাদের কর্মপ্রক্রিয়াকে বিস্তৃত করতে হয়েছে। সেটা যেমন শিক্ষা থেকে শুরু করে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিজেদের সম্পৃক্ততাকে মর্যাদাজনক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া একইভাবে কৃষি অর্থনীতির নিয়ামক সবজি চাষও গৃহকোণ থেকে ফসলী ক্ষেতে খামারের দিগন্তকে স্পর্শ করার এক দৃঢ় প্রত্যয়ও বটে। শাক, সবজির বীজ বপন থেকে শুরু করে সার্বিক তত্ত্বাবধানে আজ প্রান্তিক নারীরা যেভাবে নিজের অংশীদারিত্বকে যুগোপযোগী করেছে একইভাবে অর্থনীতির একটি বিশেষ জায়গায় তাদের অবস্থানকে মজবুত করতেও তাদের ভাবতে হয়নি। এখন শুধু সবজি ফলনই নয় বাজারজাত প্রক্রিয়াও কৃষাণীরা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করছে যা উন্নয়নের বেগবান ধারায় নারীর জোড়ালো অবস্থানকে প্রতিনিয়তই দৃশ্যমান করে তুলছে। সারা বছর বাহারি শাক সবজির নানামাত্রিক ফলনে নারীরা আজ সিদ্ধহস্ত। সারা বছরসহ মৌসুমি সবজির আবাদে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের চাহিদায়ই মেটানো নয় তার চেয়েও বেশি জুড়ে থাকে পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু সবজির বহুমাত্রিক স্বাস্থ্যবিধির নিয়মিত চর্চাও। প্রতিদিনের চাহিদার যে মাত্রায় স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টির আবশ্যক সেখানে নিজ হাতে উৎপাদিত সবজি ঘরে তোলার মতো সুখ আর আনন্দ অন্য কিছুতে আসতে পারে না। আর গ্রাম বাংলার নারী কৃষি শ্রমিকরা সেই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কাজটা তাদের প্রতিদিনের ঘামে ঝরা নিবেদনে নিরবচ্ছিন্নভাবে করেই যাচ্ছে। আর মাঠে, ক্ষেতে, খামারে সবজি চাষের এই ব্যাপক উৎপাদন আন্তর্জাতিক সীমানাকেও স্পর্শ করেছে। আর এর পেছনে রয়েছে নারীদের ব্যাপক আর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। ঘরে থেকে বহিরাঙ্গনে পা রাখা নারীরা আজ উন্নয়নের জোয়ারে নিজেদেরকে যেভাবে সম্পৃক্ত করেছে তা সত্যিই বিস্মিত আর মুগ্ধ হওয়ার মতোই। আর এরই ফলে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় স্থানে। এই অবস্থান থেকে উঠে আসতেও বেশি সময় নেবে বলে মনে হয় না। শিক্ষা এবং সমাপনী পরীক্ষাগুলোতে মেয়েদের সামনে এগিয়ে চলা সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় দিক নির্দেশনা। কৃষি অর্থনীতিতেও নারীর অভাবনীয় সাফল্য দেশের নিয়ামক শক্তি। শুধু তাই নয় অর্থনীতির অন্যান্য সূচকেও নারীর বলিষ্ঠ প্রত্যয় দেশের অন্যতম বিরাট অর্জন। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করলেও সংখ্যা খুব বেশি নয়। আর এই ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগী হতে না পারলে নারীরা হরেক রকম প্রাপ্তির সঙ্গে নিজেদের তাল মেলাতে পারবে না। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিনা রাজনীতির অঙ্গন যদি নারীদের জন্য অবাধ আর মুক্ত না হয় তাহলে অর্জিত সূচকে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়া অসম্ভব কিছু নয়। এ ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতনতা এবং দায়বদ্ধতার পরিচয় দিতে হবে।
×