ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনে সেনা টহল জোরদার

আরসা কি মিয়ানমারের সেনামদদপুষ্ট হয়ে কাজ করছে!

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১০ জানুয়ারি ২০১৮

আরসা কি মিয়ানমারের সেনামদদপুষ্ট হয়ে কাজ করছে!

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে সংগ্রামরত আরসা’র (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি) সার্বিক কর্মকা- নিয়ে রহস্যের যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়ে আছে তার অবসান এখনও হয়নি। মূলত আরসা কি এবং কাদের স্বার্থে এ সংগঠনটি কাজ করছে, তাদের শক্তি কি, কোথা থেকে তারা অর্থ সহায়তা পাচ্ছে সবই যেন গোলক ধাঁধার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সংগঠনটি প্রথমে আল ইয়াকিন নামেই পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে হয়ে যায় আরসা। বর্তমানে আরসার নাম আবারও আলোচনার পাদপীঠে। গত আগস্ট মাসে রাখাইন রাজ্যে একটি সেনাসহ ৩০টি পুলিশ নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার জন্য আরসাকে দায়ী করে সে দেশের সরকার সেনা অভিযান শুরু করে রাখাইন রাজ্যজুড়ে। এতে গণহারে রোহিঙ্গারা প্রাণ হারিয়েছে। তাদের বাড়িঘর, বসতভিটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়েছে। আর প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ সদস্য আরসার কর্মকা- নিয়ে অবহিত নয়। অনেকে আরসাকে একটি চাঁদাবাজ সংগঠন হিসেবে মনে করে থাকে। আবার রোহিঙ্গাদের মাঝে যারা সচেতন তাদের একটি অংশ মনে করে আরসা মিয়ানমার সরকারেরই মদদপুষ্ট একটি সংগঠন। এরা নামে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করছে বলে প্রচার চালালেও মূলত তাদের কর্মকা-ে রোহিঙ্গারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনাটির পর রোহিঙ্গাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা এই নৃ-গোষ্ঠীর ইতিহাসে একটি রেকর্ড। এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ইতোপূর্বে কখনও প্রাণ হারায়নি এবং দেশান্তরিও হয়নি। সঙ্গত কারণে আরসা-নাম এবং এর কর্মকা- নিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝে বিভিন্ন ধরনের জিজ্ঞাসা রয়েছে। যার কোন বিশ্বাসযোগ্য উত্তর এ পর্যন্ত মেলেনি। মূলত এ আরসা সংগঠনটির কারণে সর্বশেষ লাখ লাখ রোহিঙ্গা দেশান্তরি হতে বাধ্য হয়েছে। আর বর্তমানে এসব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ যখন একমত হয়ে কাজ করছে এবং আগামী ২২ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার প্রশ্নে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে ঠিক তখনই গেল শুক্রবার রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গাড়িতে হামলার একটি ঘটনা ঘটেছে, যার জন্য আরসাকে দায়ী করা হয়েছে এবং আরসাও এর দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে। এ ঘটনার পর বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত অবশিষ্ট দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আবারও প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকার ভীতিতে রয়েছে। শুধু তাই নয়, অনেকেই ইতোমধ্যে পালিয়ে বাংলাদেশমুখী হয়েছে। এমনিতেই রাখাইনের রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। তবে আগে যেভাবে দলে দলে এবং স্রোতের মত এসেছে বর্তমানে সে দৃশ্য আর নেই। কিন্তু গেল শুক্রবারের ঘটনার পর পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে। টেকনাফ উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বড় একটি অংশ মনে করে আরসা মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট এবং রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই তারা কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের প্রশ্ন, আরসা যদি তাদের স্বার্থে কাজ করে তাহলে তাদের কর্মকা- নিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাধারণ সদস্যদের অবহিত করা কেন হয়নি। এছাড়া মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরসার কোন ঘাঁটি উচ্ছেদ বা তাদের কোন বড় মাপের নেতাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে এমন কোন রেকর্ড নেই। তবে গত আগস্ট মাসে নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনার পর মিয়ানমার সশস্ত্র সেনাবাহিনীর গুলিতে ৫ শতাধিক আরসা ক্যাডার প্রাণ হারিয়েছে বলে প্রচার রয়েছে। এর কোন সত্যতা এ পর্যন্ত মেলেনি। মিয়ানমার সরকার আরসাকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছে। তাদের সেনাবাহিনীও তাদের কোন ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধারের প্রমাণ দিতে পারেনি। অপরদিকে, আরসার নেতৃত্বে হাফেজ মোহাম্মদ আতাউল্লাহ ওরফে আবু আম্মর জুননি নামে যার কথা প্রচার মাধ্যমে স্থান করে নিয়েছে তিনি মূলত রোহিঙ্গা বংশোদ্ভূত পাকিস্তানী নাগরিক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে জুননির বাবা মিয়ানমার থেকে পাকিস্তানে পাড়ি জমান, পরে যান সৌদি আরবে। তার পুত্র আতাউল্লাহ পড়ালেখা করেন সৌদি আরবে। সেখানকার একটি মসজিদে ইমামতিও করতেন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের নামে আতাউল্লাহ সৌদি আরবেই গড়ে তোলেন আল ইয়াকিন নামে সংগঠনটি, যা পরবর্তীতে নাম পাল্টিয়ে আরসা হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের আরও যে কয়েকটি সংগঠন রয়েছে, আরএসও, এআরএনও এবং এআরইউ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৮ সাল থেকে একের পর এক রোহিঙ্গাদের বহু সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন ইসলামী দেশ ও সংস্থা এদেরকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে বলেও প্রচার রয়েছে। এদের মধ্যে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) উল্লেখযোগ্য স্থানে ছিল। অনুসন্ধানে আরও প্রশ্ন উঠেছে, গত আগস্ট মাস থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যে অসহায় রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরতার ঘটনাগুলো ঘটে গেছে তা নিয়ে আরসার কোন তৎপরতা দেখা যায়নি। বরঞ্চ এ আরসা নিজেরা একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে। যা মিয়ানমার সরকার এককথায় উড়িয়ে দিয়েছে। এরপরে আরসার আর কোন বক্তব্য মেলেনি। পক্ষান্তরে, মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে হিংস্র ছোবল হেনেছে তা সারা বিশ্বকে হতবিহ্বহল করেছে। রোহিঙ্গাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সে দেশের এনএলডি নেত্রী আউন সান সুচিকে দেয়া বিভিন্ন পদকও কেড়ে নেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া এবং দেশান্তরি করার ঘটনায় বিশ্ব চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার শেষ পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান বন্ধ করেছে এবং পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সম্মত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ১৫ জানুয়ারি মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত হবে দুদেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক। যেখানে একলাখ রোহিঙ্গার একটি তালিকা উপস্থাপন করা হবে। এরপর ২২ জানুয়ারির মধ্যে শুরু হবে প্রত্যাবাসন। এমনিতর অবস্থায় হঠাৎ করে আরসা কিভাবে গত শুক্রবার কোন শক্তির বলে সেখানকার সেনাবাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালাল। এ ঘটনার সত্যতা কি? যদি সত্যতা থেকে থাকে তাহলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতেই ষড়যন্ত্র কিনা এমন প্রশ্নও রোহিঙ্গাদের মাঝে আলোচিত হচ্ছে। মিয়ানমার সরকার বার বার বলে আসছে, আরসার হামলার কারণেই রাখাইনে সেনা অভিযান চলেছে। আবার গত শুক্রবারের ঘটনাকেও আরসা দ্বারা সংঘটিত বলে দাবি করা হচ্ছে। আরসার পক্ষ থেকেও এর দায় স্বীকার করা হয়েছে। সঙ্গত কারণেই বড় প্রশ্নটি উঠেছে, আরসা কি রোহিঙ্গাদের স্বার্থে কাজ করছে, না মিয়ানমার সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে সচেষ্ট রয়েছে। মূলত রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের নামে আরসাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও নানা প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর কখনও মেলেনি। মূলত আরসার পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে তারা আরাকান রাজ্যের স্বাধীনতা চায় না, তারা চায় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বসহ মৌলিক সকল অধিকার। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, আরসার অধিকাংশ কর্মকা- সন্ত্রাসী কায়দায় গড়ছে। ফলে সংগঠনটিকে একটি জঙ্গী সংগঠন হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে। শুধু তাই নয়, এ সংগঠনের সঙ্গে আল কায়দার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলেও দাবি রয়েছে। কিন্তু সবই ধোঁয়াশার আঁধারে ঢাকা। এদের কর্মকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। হাজার হাজার প্রাণ দিয়েছে। নারী ও যুবতীরা ধর্ষিত হয়েছে। গেল বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা দেশান্তরি হয়েছে, যা বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে আশ্রিত হয়েছে। খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সহায়তা পেলেও এরা মূলত মানবেতর জীবনেই রয়েছে। এদের মধ্যে বর্তমানে প্রত্যাবাসন প্রশ্নে আবারও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করা হয়েছে। অনেকেই ফিরে যেতে চায় নিজভূমে। কিন্তু অনেকেই আবার ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। কেননা, মিয়ানমার সরকার বহু আগে থেকেই দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের ওপর হামলে পড়েছে। পরে ফিরিয়ে নিয়েছে। আবার হামলাসহ নিধনযজ্ঞ চালানো হয়েছে। মূলত মিয়ানমার সরকার চায় রাখাইনকে রোহিঙ্গাশূন্য করতে। গত আগস্টের অভিযানের পর অনেকাংশে শূন্য হয়েছে। এখন রয়েছে মাত্র দুই লক্ষাধিক। এ অবস্থায় আরসার পক্ষ থেকে সেনা যানে হামলার যে দাবি উঠেছে তা সন্দেহের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা, এ ঘটনাটি নিয়ে সে দেশের সেনাবাহিনী আবার তৎপর হয়েছে। আর সে দেশে অবস্থানরত অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা ভীতিতে দেশ ছাড়ার প্রশ্নে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রয়েছে। অনেকেই বাংলাদেশমুখী হয়েছে। বিভিন্ন ফাঁক ফোকরে এরা টেকনাফের সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এপারের ভূখ-ে আশ্রয় নিচ্ছে। এমনিতর পরিবেশে জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসা যে- আরসা কার স্বার্থে কাজ করছে। মূলত রোহিঙ্গাদের অধিকার নামে হলেও এদের কর্মকা- প্রকারান্তরে মিয়ানমারের স্বার্থসিদ্ধিতে নিয়োজিত বলেই প্রতীয়মান। অপরদিকে, আরসা নামের সংগঠনটির ক্যাডার বাহিনী যদি থেকে থাকে তাহলে মিয়ানমারের মতো সেনাবাহিনী তাদের খুঁজে বের করতে কেন ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে তাও একটি বড় ধরনের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদৌ মিয়ানমার বাহিনী আরসাকে দমন করতে চায়, না রোহিঙ্গাদের রাখাইনমুক্ত করতে আরসাকে মদদ দিয়ে তাদের পরিকল্পিত নীলনক্সা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে- এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোতে। এদিকে, সর্বশেষ টেকনাফের সাবরাং শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে শতাধিক নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। মঙ্গলবার ভোরে শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণপাড়া, জালিয়াপাড়া ও পশ্চিমপাড়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। পরে তাদের নয়াপাড়া ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে । রাখাইনে সেনা টহল বৃদ্ধি ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সেনা টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত শুক্রবার মিয়ানমারের মংডুতে সেনাবাহিনীর গাড়িতে সশস্ত্র রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার ক্যাডারদের হামলার অভিযোগের পর মংডু এলাকাসহ যেসব জায়গায় রোহিঙ্গাদের বসতি রয়েছে, ওসব স্থানে সেনা টহল জোরদার করা হয়েছে বলে ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে।
×