ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শওকত ওসমানের জন্মশতবর্ষে বাংলা একাডেমিতে ‘শতাব্দী পেরিয়ে’

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৩ জানুয়ারি ২০১৮

শওকত ওসমানের জন্মশতবর্ষে বাংলা একাডেমিতে ‘শতাব্দী পেরিয়ে’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নিছক সাহিত্যের জন্য সাহিত্যচর্চা নয়, মানুষের জন্য সাহিত্য রচনা করেছিলেন শওকত ওসমান। স্বদেশের প্রতি দায়বোধ থেকেই কলম ধরেছিলেন সমাজমনস্ক এই লেখক। মানুষের মনের ভাবকের পুঁজি করে সৃষ্টি হয়েছে তার সাহিত্য। লেখনীর আশ্রয়ে কথা বলেছেন শোষিত মানুষের পক্ষে। আর লিখতে গিয়ে কখনও শাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় করেননি। তুমুলভাবে আঘাত করেছেন ধর্মান্ধতাকে। জন্মশতবর্ষে এভাবেই বিশিষ্টজনদের কথনে মূল্যায়িত হলেন স্বদেশের প্রতি দায়বদ্ধ কথাশিল্পী শওকত ওসমান। মঙ্গলবার ছিল বরেণ্য কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের ১০১তম জন্মদিন ও শততম জন্মবার্ষিকী। তার জন্মদিন উপলক্ষে এদিন বিকেলে ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক ও লেখক আহমদ রফিককে প্রদান করা হয় আজীবন সম্মাননা। আয়োজনে ঘোষণা দেয়া হয়, এ বছর থেকে এপেক্স ফুটওয়্যারের সৌজন্যে ‘শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করা হবে। শওকত ওসমানের ছেলে জাঁ-নেসার ওসমান এ ঘোষণা দিয়ে জানান, এ বছর আজীবনের সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হলো আহমদ রফিককে। আগামী বছর থেকে আজীবন সম্মাননার পাশাপাশি তরুণ সাহিত্যিকদেরও পুরস্কৃত করা হবে। সম্মাননার সম্মানী হিসেবে আহমদ রফিককে এক লাখ টাকার চেক ও স্মারক প্রদান করা হয়। লেখকের জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিবেদনের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কথাশিল্পী শওকত ওসমান স্মৃতি পরিষদ। সহযোগিতায় ছিল এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড। শওকত ওসমানকে নিবেদিত বিশিষ্টজনদের আলোচনা এবং নৃত্য-গীতের পরিবেশনায় সাজানো হয় আয়োজন। আহমদ রফিকের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন শওকত ওসমানের ছেলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী। স্বাগত বক্তব্য দেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম লিটু। শওকত ওসমান সাহিত্য পুরস্কারের ঘোষণা দেন লেখকের আরেক ছেলে জাঁ-নেসার ওসমান। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মেরিন নাজনীন। সভাপতির বক্তব্যে সম্মাননাপ্রাপ্তি অনুভূতি ব্যক্ত করে আহমদ রফিক বলেন, এটা একইসঙ্গে আমাকে বিব্রত ও আনন্দিত করেছে। শওকত ওসমানের মূল্যায়ন করে তিনি বলেন, জাতি হিসেবে আমরা ঐতিহ্য অসচেতন। তাই শওকত ওসমানের মতো লেখকের সৃষ্টিকর্মের নির্যাস আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে না। তার মতো লেখকের জীবন ও সাহিত্য শিক্ষণীয় বিষয়কে গ্রহণ করতে হবে। আর শওকত ওসমান যতটা সাহিত্যিক ছিলেন ঠিক ততটাই প্রখর রাজনীতিমনস্ক মানুষ ছিলেন। সে রাজনীতি কখনও জাতীয়তাবাদী চেতনার আবার কখনও সমাজ পরিবর্তনের ভাবনাতাড়িত ছিল। এছাড়া বিশ্বসাহিত্য থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছেন শওকত ওসমান। বিশ্বসাহিত্য পাঠের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে তার জীবনবোধ। যে জীবনবোধ ছিল মানবতাবাদী সমাজের প্রতি ধাবিত। এই লেখককে সম্মান জানাতে হলে পড়তে হবে তার রচিত ‘ক্রীতদাসের হাসি’ ও ‘জননী’র মতো মনন আলোড়িত সাহিত্যকর্মগুলো। পিতৃস্মৃতিচারণ ও আলোচনায় ইয়াফেস ওসমান বলেন, আপন কর্মগুণেই সমাজে কিছু পরিণত হয় পথ প্রদর্শকে। তেমনই একজন শওকত ওসমান। তাকে দেখে একসময় আমার মনে হয়েছে, সাহিত্যিক নয় তিনি হয়তো রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছিলেন। তাই তার সাহিত্যেও অনেক বেশি উচ্চকিত হয়ে উঠে এসেছে রাজনীতি। তিনি কখনও নিজের জন্য ভাবেননি। সারাজীবন সৎভাবে বেঁচে থাকার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। কিন্তু কখনও আপোস করে নিজ অবস্থানের পরিবর্তন করেননি। সব মিলিয়ে ভিন্ন এক জীবনবোধের মানুষ ছিলেন শওকত ওসমান। ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করে ইয়াফেস ওসমান বলেন, বাবার সততার কারণে আমরা সচ্ছল জীবনযাপন করিনি। প্রায়শই এক ভাইয়ের পোশাক আরেক ভাই পরতাম। আমি যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম, তখন আমার নিজের কোন ভাল পোশাক ছিল না। তাই বাবার শার্ট ও প্যান্ট পরে সেদিন ইন্টারভিউ বোর্ডে হাজির হয়েছিলাম। শামসুজ্জামান খান বলেন, লেখক হিসেবে অতুলনীয় ছিলেন শওকত ওসমান। তিনি যখন যে বিষয়ে লিখেছেন, সেই বিষয়ে তার চেয়ে অভিজ্ঞ আর কাউকে মনে হয়নি। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শওকত ওসমানের ব্যবহৃত জিনিসপত্র বাংলা একাডেমির সাহিত্য জাদুঘরে হস্তান্তর করা হয়। আয়োজনের সূচনা হয় সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে। অনি গেয়ে শোনান ‘শত জনমের স্বপ্ন তুমি’। তন্বী সাহার কণ্ঠে গীত দু’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘প্রতিদিন আমি হে জীবন স্বামী’ ও ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’। এছাড়া আলোচনা শেষে নাচ ও গানের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ পর্বে ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ গানের সুরে নাচ করেন প্রিয়াঙ্কা বড়ুয়া পিউ। তন্বী সাহা গেয়ে শোনান ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে’। গান ও কথায় স্মরণে ফিরোজ সাঁই ॥ স্মৃতিচারণ ও সঙ্গীত পরিবেশনায় স্মরণ করা হলো একুশে পদকপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পী ফিরোজ সাঁইকে। স্মরণের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফিরোজ সাঁই স্মৃতি সংসদ। আগামী ১২ জানুয়ারি এই শিল্পীর ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে মঙ্গলবার বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্মৃতিচারণের পাশাপাশি অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয় ফিরোজ সাঁইয়ের জনপ্রিয় গানগুলো। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ফিরোজ সাঁইয়ের সঙ্গীত জীবনের নানা বিষয়ের স্মৃতিচারণ করেন শিল্পী নুরুন্নাহার আউয়াল, শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সহকারী পরিচালক এনায়েত এ মওলা জিন্নাহ প্রমুখ। বক্তারা বলেন, ফিরোজ সাঁই ছিলেন অসাধারণ গুণী শিল্পী, সত্য ও সুন্দরের পূজক। তার গানের ভেতর ছিল আধ্যাত্মিকতা। বিশ্বায়নের এ যুগে বিভিন্ন কোম্পানি কত আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করে কিন্তু ফিরোজ সাঁইকে আমাদের স্মরণ করতে হয় অনাড়ম্বরভাবে। ফিরোজ সাঁই স্মরণের এই আয়োজনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন তার শিষ্য ও স্মৃতি সংসদের সভাপতি ফারুক ভূঁইয়া ও গিটারিস্ট স্বপন। ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা’ গানটি দিয়েই নিজের পরিবেশনা শুরু করেন ফারুক ভূঁইয়া। এরপর একে একে তিনি পরিবেশন করেন স্কুল খুইলাছেরে মাওলা, ইচ্ছাতে তোমার, হাত দিলা পা দিলা, মন তুই চিনলিনারে, পাগল হইতে চাইলে, আইছি একা যাইমু একা, তারে পাইতে যদি চাও, রং দেখিয়া যায়না চেনা, ইঞ্জিন যদি চইলা যায়, গাউছুল আজম বাবা ও পাসপোর্ট ভিসা লাগেনাসহ ১২টি গান। এছাড়া শিল্পী স্বপন পরিবেশন করেন নীলা তুমি আবার আস ফিরে। যন্ত্রসঙ্গীতের সুরধ্বনিতে মুখর শিল্পকলা ॥ সোমবার থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হওয়া দশ দিনের জাতীয় যন্ত্রসঙ্গীত উৎসব। মঙ্গলবার উৎসবের দ্বিতীয় দিনেও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের সুরধ্বনিতে মুখরিত হয়েছে শিল্পকলার আঙ্গিনা। এদিন সন্ধ্যায় একাডেমির নন্দনমঞ্চে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে লোকজ সুর আর রাগসঙ্গীত পরিবেশনা করেন তারা। সেতারে ফিরোজ খান, বেহালায় আবরার, বাঁশিতে আজিজুল ইসলামের যৌথ পরিবেশনায় শুরু হয় দ্বিতীয় দিনের পরিবেশনা। সুনামগঞ্জ জেলার শিল্পীদের পরিবেশনা ছিল এরপর। যৌথ পরিবেশনায় হারমোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, দোতারা, নাল, মন্দিরা, জিপসি, খঞ্জনি বাজিয়ে শোনান দেবদাস চৌধুরী রঞ্জন ও সোহেল রানা, অঞ্জন চৌধুরী ও বাবুল আচার্য্য, জায়েদ মাহমুদ, বাউল রশীদ উদ্দিন, কপিল ঋষি, অমিত বর্মণ, অরিজিৎ ঘোষ চৌধুরী, আহসান জামিল আনাছ এবং সামির পল্লব। বাংলা ঢোল, বাঁশি, খমক ও জিপসি, দোতার, তবলা, মন্দিরা, জুরিতে লোকজ সুর বাজিয়ে শোনান যশোরের শিল্পী সাঈদ আহমেদ খান, আজিজুর রহমান, মকবুল হোসেন, নকুল কুমার বিশ্বাস, প্রবীর ব্যানার্জী, অমিত বিশ্বাস ও মোঃ ফারুক হোসেন, মানিক বর্মণ, তাপস সরকার এবং মিলন কুমার দাস। রাজবাড়ির শিল্পীদের মধ্যে হারমোনিয়ামে চপল কুমার সান্যাল ও জান্নাতুল ফেরদৌসী মিমি, তবলায় বিমল রায়, দোতারায় মেহেদী হাসান, তানপুরায় নিজাম আনসারী, বাঁশিতে সোহরাব হোসেন, করতালে তপন শীল এবং বেহালায় আবরার রাজবাড়ীর লোকজ গান পরিবেশন করেন। উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গীত পরিবেশন করেন নাটোরের বাঁশিবাদক জাহিদুল ইসলাম, আব্দুল আউয়াল ও সুমিত কুমার সরকার। তাদের সঙ্গে বেহালায় সঙ্গত করেন বিজন কুমার মন্ডল, দোতারায় জাহাঙ্গীর আলম মিলন। হারমোনিয়াম ও তবলার কীর্তন পরিবেশন করেন প্রশান্ত কুমার দাস ও পলাশ কুমার দাস। খোল ও পাখোয়াজের উপস্থাপনায় ‘লছিমন’ পরিবেশনায় ছিলেন বিমল হালদার, সিদ্দিকুর রহমান, সুকুমার সরকার। মেহেরপুরের তবলাবাদক জাহাঙ্গীর সেন্টু বিভিন্ন তাল পরিবেশন করেন। এ জেলার শিল্পীদের পরবর্তী পরিবেশনায় হারমোনিয়ামে দেশাত্মবোধক সুর বাজিয়ে শোনান এখলাসুর রহমান ও এম সাইদুর রহমান। বাঁশিতে পল্লীগীতি পরিবেশন করেন আশিকুর রহমান লাল্টু। ক্লারিওনেটে রাগ ইমন পরিবেশন করেন আমিনুল ইসলাম। এছাড়া দোতারায় লোকজ সুর শোনান আবদুল্লাহ আল মামুন, তাকে বাংলা ঢোলে সঙ্গত করেন সজিব। রাহাত আরা গীতির সঙ্গীতসন্ধ্যা ॥ জাতীয় জাদুঘরের নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে নজরুল সঙ্গীতশিল্পী রাহাত আরা গীতির একক সঙ্গীতসন্ধ্যার আয়োজন করা হয়। রাহাত আরা গীতি গেয়ে শোনান ‘ঝরা ফুল’, ‘কার নিকুঞ্জে’, ‘স্বপ্নে দেখি’, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’, ‘মেঘ বরণ কন্যা থাকে’, ‘আকাশে হেলান দিয়ে’ ও ‘বলে ছিলে তুমি’। অনুষ্ঠানে তিনি বেশকিছু লোকসঙ্গীতও পরিবেশন করেন।
×