ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন বছরে সুখবর

কাঁটামুক্ত ইলিশের স্যুপ নুডলস যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকায়

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১ জানুয়ারি ২০১৮

কাঁটামুক্ত ইলিশের স্যুপ নুডলস যাচ্ছে ইউরোপ আমেরিকায়

সমুদ্র হক ॥ নতুন বছরে ইলিশ এনেছে সুখবর। কাঁটার ভয়ে যারা ইলিশ মাছ পাতে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, তাদের জন্য নতুন বছরের প্রথম দিকেই আসছে কাঁটাবিহীন ইলিশ। বিশ্বে এই প্রথম বাংলাদেশ কাঁটা অবমুক্ত করে ইলিশ প্রক্রিয়াজাত করে বানিয়েছে স্যুপ ও নুডলস। ইলিশের আরও একটি সুখবর : বিশ্বের বিভিন্ন সাগর তীরের যে ১১ দেশে ইলিশ উৎপাদিত হয় তার দশটিতেই উৎপাদন কমেছে। একমাত্র বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছ। ইলিশ প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি শুরু হলে ইলিশের উৎপাদনও বাড়াতে হবে। কারণ- যে কাঁটার ভয়ে ইউরোপ আমেরিকার মানুষ ইলিশ খেত না, তারা কাঁটাবিহীন ইলিশ পেলে তা লুফে নেবে। প্রক্রিয়াজাত ইলিশ রফতানি বেড়ে যাবে। মৎস্য অধিদফতর অবশ্য আশাবাদী হয়ে জানিয়েছে, ক’বছর ধরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদফতর, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ সম্মিলিত জাটকা রক্ষায় যে অভিযান চালাচ্ছে তাতে উৎপাদন শীঘ্রই আরও অন্তত দু’লাখ মেট্রিক টন বেড়ে যাবে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয় প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন। পাঁচ বছর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল সাড়ে তিন লাখ মে.টন। জাতীয় মাছ ইলিশের কদর শুধু বাংলাদেশেই নয় ভারতেও বেশি। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৬৫ শতাংশই বাংলাদেশের। ভারতের ১৫ শতাংশ ও মিয়ানমারের ১০ শতাংশ। বাকিটা অন্য আট দেশের। এই জরিপ ওয়ার্ল্ড ফিশের। মৎস্য অধিদফতরের উপ পরিচালক ও ইকো ফিশ বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক এ এস এম রাশেদুল হক জানান, দেশে এই প্রথম ইলিশ প্রক্রিয়াজাত করে স্যুপ ও নুডলস তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। কাঁটা অবমুক্ত করে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের উদ্ভাবক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ময়মনসিংহ) মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের মাৎস্য প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. নওশাদ আলম। ইলিশ পণ্য উদ্ভাবন ও বাজারজাতকরণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় গবেষণা করেন তিনি। দীর্ঘ গবেষণা শেষে গত অক্টোবরে এই সাফল্য এসেছে। স্যুপ ও নুডলস অনেকটা সময় সংরক্ষণে সফলতা এসেছে। এই বিষয়ে রবিবার অধ্যাপক ড. নওশাদ আলমের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মূলত অনেকদিন ধরেই তিনি এই গবেষণা করছেন। ওয়ার্ল্ড ফিশ সেন্টারের ইকো ফিশ প্রজেক্টের আওতায় গবেষণার ধারাবাহিকতা শুরু করেন। বছর দুয়েক আগে ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশের সহযোগিতায় সমঝোতা স্মারক (মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং) স্বাক্ষর হয়। প্রকল্প পরিচালক রাশেদুল হক বলেন, এ বছর জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারিতে মৎস্য অধিদফতর এই সফল প্রযুক্তিটি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করবে। এরপর প্রাথমিকভাবে একটি কোম্পানি ইলিশ প্রক্রিয়াজাত স্যুপ ও নুডলস তৈরি করে বাজারজাত করবে। উদ্ভাবক ড. নওশাদ আলম বলেন, ইলিশের এই প্রক্রিয়াজাত পণ্য বিশ্বে এই প্রথম। ইলিশের স্বাদ ও গন্ধ সম্পূর্ণ ঠিক রেখে প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে স্যুপ ও নুডলস তৈরি সম্ভব হয়েছে। অর্গানিক পদ্ধতিতে তৈরি এই পণ্যে কোন ক্ষতিকর উপাদান থাকবে না। ইলিশের গুঁড়া এবং কিমার উপাদানে পেস্ট (যা কিউব) বায়ুরোধক পাত্রে অন্তত এক বছর রাখা যাবে। হিমায়িতকরণের মাধ্যমে আরও কিছুটা সময় সংরক্ষণ করা যাবে। তিনি জানান, সাগরের ইলিশে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড থাকে। এই ইলিশ নদীতে এলে তা ধারণ করে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড। যা সাধারণত ধরে রাখা যায় না। গবেষণায় এই অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড ধরে রাখার সফলতা এসেছে। যে কারণে ইলিশ প্রক্রিয়াজাত করা গেছে। তৈরি হচ্ছে স্যুপ নুডলস। এতে ইলিশের যে পুষ্টিমান তা সবই ঠিক থাকবে। ইলিশের স্বাদ গন্ধ ঠিক রাখতে ইলিশের তেল বা চর্বি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঠিক রাখা হয়েছে। ইলিশের মধ্যে খাবার উপযোগী উপাদান ৬০ শতাংশ। এ ছাড়াও আছে আমিষ ও খনিজ চর্বি, ওমেগা-৩ ফ্যাট, অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড, নয় ধরনের এ্যামাইনো এসিড, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, যকৃতে আছে ভিটামিন এ, তেলে আছে ভিটামিন এ বি ডি। প্রক্রিয়াজাত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করবে মৎস্য অধিদফতর। ইলিশে কত কাঁটা-এর একটি হিসাব কষেছেন ইলিশপ্রেমী এক বাঙালী। এক কেজি ওজনের একটি ইলিশে কাঁটার সংখ্যা অন্তত দশ হাজার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শেফ কলকাতার মার্কোপোলো রেস্তরাঁর অমিতাভ চক্রবর্তীর কাছ থেকে পাওয়া কাঁটার হিসাব দিয়েছেন বরেণ্য সাহিত্যিক শংকর, তার খাওয়া দাওয়া গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন ইলিশে কাঁটা আছে বলেই বাঙালীর পাতে ইলিশ মিলছে। না হলে বাগদা গলদা চিংড়ির মতো ইলিশ চলে যেত ইউরোপ আমেরিকায়। তারা কাঁটার আঘাতে অপঘাতে মৃত্যুর ভয়ে ইলিশ সরিয়ে রেখেছে। এখন ইলিশ কাঁটামুক্ত হলে তারা ইলিশের স্যুপ ও নুডলস কিনতে উৎসাহিত হবে। বাংলাদেশ ইলিশের উৎপাদন বাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাত পণ্য তৈরি করে দেশের বাইরে পাঠাতে পারে। আসবে বৈদেশিক মুদ্রা। দুই দিক থেকেই বাংলাদেশের লাভ। প্রাচীন ইতিহাসখ্যাত ইলিশ। যা আছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে, পদ্মাপুরাণ, চ-ীমঙ্গল, ভারতচন্দ্রের রচনায়, দ্বিজবংশী বদন দাসের মনসামঙ্গল কাব্যে। একবিংশ শতকে এই ইলিশ আরেক ইতিহাস তৈরি করতে যাচ্ছে। যাতে কোন কাঁটা থাকবে না।
×