ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এসেছে কেমিক্যাল খাতে

তিন মাসে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ৭ হাজার কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৩ নভেম্বর ২০১৭

তিন মাসে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ ৭ হাজার কোটি টাকা

রহিম শেখ ॥ বাড়ছে বিনিয়োগ। চলতি অর্থবছরের গত তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। আগের তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে ৪ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে নিট এফডিআই বেড়েছে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এসেছে কেমিক্যাল খাতে। জানা গেছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বর্তমানে অন্তত ১৭টি খাতে কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছেন বিদেশীরা। তাদের মুনাফা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রেও বিধি-বিধান শিথিল করা হয়েছে। মুনাফাসহ শতভাগ মূলধন ফেরত নেয়ার পাশাপাশি নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় যন্ত্রপাতির অবচয় সুবিধা, শুল্কমুক্ত যন্ত্রাংশ আমদানি এবং রফতানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন বিদেশীরা। পাশাপাশি রয়েছে সস্তা শ্রমের সহজলভ্যতা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব সুযোগ-সুবিধার জন্যই বিদেশীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে তারা টেলিকমিউনিকেশন, টেক্সটাইল, জ্বালানি, গ্যাস ও বিদ্যুত এবং ব্যাংক-বীমায় বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এর জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জমি সঙ্কট, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাব, অবকাঠামো সমস্যা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে দায়ী করেন তারা। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত তিন মাসে ১০টি শতভাগ বিদেশী ও ২০টি যৌথ বিনিয়োগের পরিমাণ ১ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। এর আগের তিন মাসে ৪৭টি নিবন্ধিত শিল্পের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সে হিসাবে গত তিন মাসে বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে ১ হাজার ৪২ শতাংশ। গত তিন মাসে সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে কেমিক্যাল খাতে। এ খাতে মোট বিদেশী বিনিয়োগে পরিমাণ ৩৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯ দশমিক ৭২ শতাংশ এসেছে সার্ভিস শিল্প খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রকৌশল শিল্প খাতে। এছাড়া কৃষি খাতে ৪ দশমিক ১১ শতাংশ, টেক্সটাইল খাতে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ, বিবিধ শিল্প খাতে ১৫ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং শিল্প খাতে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৩৯১টি শিল্পে মোট ৬ হাজার ৬৬ হাজার ৪৯১ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গত তিন মাসে বিদেশী বিনিয়োগের পাশাপাশি স্থানীয় বিনিয়োগও আশানরূপ বেড়েছে। এই সময়ে ৩৬১টি শিল্প ইউনিটের প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে। যার পরিমাণ ৫ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। এর আগে তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল-জুন সময়ে স্থানীয় বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধিত ৩৯৬ শিল্প ইউনিটে প্রস্তাবিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। সে অনুযায়ী স্থানীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১১ সালে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ প্রথমবার ১০০ কোটি ডলার অতিক্রম করে। ওই বছর এর পরিমাণ ১১৩ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। পরের ৩ বছরও প্রবৃদ্ধি বজায় থাকলেও তা শত কোটি ডলারের ঘরেই আটকে ছিল। এর পরের বছর ২০১৪ সালে এফডিআই প্রায় ৪ শতাংশ কমে যায়। তবে ২০১৫ সালে রেকর্ড পরিমাণ বাড়ে এবং প্রথমবার ২০০ কোটি ডলারের ঘর অতিক্রম করে। ২০১৫ সালে নিট বিদেশী বিনিয়োগ আসে প্রায় ২২৪ কোটি ডলার, যা ২০১৪ সালের চেয়ে ৪৪ শতাংশ বেশি। ২০১৬ সালেও এফডিআই প্রবৃদ্ধির হার ইতিবাচক ধারায় ছিল। এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) পরিস্থিতি নিয়ে প্রতি বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আঙ্কটাড)। সর্বশেষ গত বছরের ২২ জুন ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ২০১৪ সালের চেয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের নিট এফডিআই বেড়েছিল প্রায় ৪৪ শতাংশ। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পরিমাণ বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে বিশ্বমানের কিছু উদ্যোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। এটা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে হয়েছে, ওষুধের ক্ষেত্রে হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে হয়েছে। উদ্যোক্তাদের নতুন প্রজন্ম অনেক সক্ষম ও প্রতিভাবান। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়। তিনি বলেন, ভারত ও অন্যান্য দেশ এ সুযোগ নিচ্ছে। আমরাও বিষয়টাকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দেখতে পারি। সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সম্ভাবনাটাকে কাজে লাগাতে পারি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছেÑ এটি দেশের জন্য ভাল খবর। তবে এতে অতি উৎসাহী হওয়ার কিছু নেই। ছোট একটি দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, কম্বোডিয়ার মতো দেশে বছরে ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ আসে, সেখানে বাংলাদেশে আসছে ১৫০ থেকে ২০০ কোটি ডলার। তাছাড়া বিদেশী বিনিয়োগ ইয়ার টু ইয়ার একটু বেশি ভেরিয়েশন হয়। এজন্য আগামীতে কী হয়, সেটিই দেখার বিষয়। তিনি মনে করেন বিদ্যমান অবকাঠামো সমস্যার সমাধান, দুর্নীতি রোধ ও জমির সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা গেলে আগামীতে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের বিনিয়োগ পরিবেশের খুব উন্নতি হয়েছে তা নয়। তারপরও বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে, যা দেশের জন্য ইতিবাচক। তিনি আরও বলেন, বিদেশী বিনিয়োগ বাড়লে দেশী বিনিয়োগও বাড়ার কথা। কিন্তু দেশী বিনিয়োগে সে রকম গতি আসছে না।
×