ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুন্ডু

বিবর্তনে তোমার আমি

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১২ অক্টোবর ২০১৭

বিবর্তনে তোমার আমি

অস্কারপ্রাপ্ত চলচিত্র দ্য আর্টিষ্ট। নির্বাক যুগের হলিউডের এক সফল অভিনেতা কিন্তু সবাক যুগে এসে যন্ত্রের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাতে না পেরে ব্যার্থতার গহীন খাদে নিক্ষিপ্ত। সফল সময়ে এক আগ্রহী অভিনেত্রীকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিল তখন কার সফল অভিনেতা। আজ তার নিজরই ব্যার্থতার কালে তাকেই আবার সফলতার শিখরে তুলে ধরে এক সময়ের ঐ আশ্রয় পাওয়া অভিনেত্রী। জীবনে দান প্রতিদান সদাই ঘূর্ণীয়মান। কলেজ স্ট্রীট নামের বইপাড়ার পুরনো বইয়ের দোকানের মালিক প্রৌঢ় অজিত নারায়ন দাশগুপ্ত তিন পুরুষের পরমপরায় দোকান চিরায়ত ‘গ্রন্থবিপনী’ চালিয়ে, প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের এবং অনুরাগী পাঠক-পাঠিকাদের জ্ঞানপিপাসা সফলতার সঙ্গে মিটিয়ে আজ নিঃস্ব এবং বিপন্ন। প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত আগ্রাসানে বিকল্প পাঠ্যাভাস আর বিশ্বায়নের বৃহৎ কলেরবের বাজারের যাঁতাকালে স্বল্প পুঁজির বেচাকেনার দহনকালে চিরায়ত গ্রন্থবিপণি চিরদিনের মতো লোটা কম্বল গুটিয়ে ব্যাক টু প্যাভিলিয়নের দ্বার গোড়ায়। ঠিক তখনই অজিত নারায়ণ দাশগুপ্তের পাশে এসে দাঁড়ায় তারই দোকনের খ-কালীন কর্মী এবং সাহিত্যানুরাগী যুবতী মায়া। মায়ার মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিভঙ্গি, সময়ের পরিবর্তন শীলতাকে মেনে মানিয়ে উঠবার দৃঢ়তা আর মনিবের চিরায়ত গ্রন্থবিপণি রুপি ঐতিহ্যকে আধুনিক তোমার আমি মোড়কে বেঁেধ ফেলার এবং বাঁচিয়ে রাখার প্রেরণাদায়ী নাটক ‘তোমার আমি’। ৬ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত মোট দশদিনব্যাপী গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবের চতুর্থদিনে গত ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়, স্লোভেনিয়ার নাট্যকার এভান্ড ফ্লিশারের নাটক টেক মি ইনটু ইয়োর হ্যান্ডস অবলম্বনে, অমিতাভ দত্তের রূপান্তর ও নির্দেশনায়, গণকৃষ্টির প্রয়োজনায় নাটক তোমার আমি মঞ্চায়িত হলো দেবশঙ্কর হালদার ও সোমা দত্তের নয়নাভিরাম অভিনয়ের স্বপ্নমায়ায়। স্বপ্নও না মায়াও না বাস্তবতা হলো সভ্যতার সঙ্কট আজ নিঃসঙ্গতা আর সেখানে থেকে উদ্বুুদ্ধ অস্তিত্বহীনতা । যে কারণে স্ত্রীকে অকালে হারিয়ে, সন্তানদের কর্মব্যস্ততায় উপেক্ষিত হয়ে অজিত নারায়ণ দাশগুপ্ত একা এবং তার অবলম্বন বইয়ের দোকান। কিন্তু তার দোকানও যখন আর থাকছে না তখন তো সে অস্তিত্বহীন এবং পরিত্যক্ত মানুষ ছাড়া আর কিছু না। লক্ষ্যহীনা, চঞ্চলা এবং কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া মায়া একের পর এক ঢেউয়ের তোড় সামলিয়েও শেষ পর্যন্ত দিশেহারা-দিকহারা। এভান্ড ফ্লিশারের এই দিকহারা-দিশেহারা হয়ে দিক খোঁজার দর্শনকে অবিকল রেখে কলেজ স্ট্রিট পাড়ার গৌরব-প্রবাহমানতা এবং ক্ষয়িষ্ণুতাকে প্রায় মৌলিক নাটক রচনার মতো করে রূপান্তরিত করতে পারায় রূপান্তকারী অমিতাভ দত্ত সত্যিই অনুকরণীয়। অনুনয়-বিনয় কিংবা প্রশ্রয় ভেবে বলার বিষয় নয়, বাস্তবতা হলো কানন দেবীর মূল্যায়নে সুচিত্রা সেন যেমন প্রযোজক-পরিচালকের বিপরীতে সময়ের বিদ্রোহ প্রকাশ, উত্তম কুমারের আগে নাম বসাতে পারাটা যেমন তার দক্ষতা ও ক্ষমতা অনেকটা তেমনি বর্তমান সময়ে গৌতম হালদার দেবশঙ্কর হালদার অভিনীত নাটক তাদেরই উপস্থাপনা। সেখানে নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা-অভিনেত্রী-কলাকুশলী তাদের যোগ্যতা নিয়েই যোগ্য সহযোগী এবং সেকারণেই সহযাত্রী। ফলে নির্দেশক অমিতাভ দত্তের নির্দেশনা নিয়ে পৃথক করা হলো না কেননা চাঁদের সঙ্গেই সংযুক্ত তার জ্যো¯œা তা সে সেমিনারে আমন্ত্রিত প্রাবন্ধিক যতই এই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নামের বিজ্ঞাপিত প্রসঙ্গ নিয়ে উষ্ণা প্রকাশ করুক না । উষ্ণা প্রকাশ তো অবান্তর বরং তোমার আমি প্রদর্শনের আগের দিন দেবশঙ্কর হালদার একক অভিনীত ‘বর্ণ পরিচয়’ নাটক দেখে অন্বেষনের বিষয় একজন অভিনেতা কথক থেকে শিশু, শিশু থেকে দাদু, দাদু থেকে পুত্র, পুত্র থেকে পুত্রবধূ, পুত্রবধূ থেকে দেবর, দেবর থেকে বন্ধুর বোন, বন্ধর বোন থেকে শান্তিনিকেতনের পেইনটিংয়ের ছাত্রী হয়ে পর্যায়ক্রমে নকশাল আন্দোলন, কর্পোরেট কর্মী, দাম্ভিক পুলিশ, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কাকা প্রভৃতি এত এত চরিত্র যৎসামান্য প্রপস-কস্টিউমের সার্পোট আর দৈহিক-বাচিক-আত্মিক সর্বোচ্চ অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে দৃশ্য থেকে দৃশ্যন্তরের এত দৃশ্যকল্প তৈরি করলেন কিভাবে, কোন পথ ধরে এগিয়ে! তোমার আমি নাটকে অজিব বাবু চরিত্র কি ভুলবার! বইয়ের ক্রেতা-বিক্রেতাকে ছাড়িয়ে বইয়ের অনুরাগীর শুভ্র দর্শন, তিন প্রজন্মের বনেদি মেজাজ দেহে লেপ্টে ধারণ, শক্তিশালী দৈহিক আবেদনের মুখে ইস্পাত দৃঢ় নির্লিপ্ততা, একাকিত্বকে একক শক্তিতে গলধকরণ, সান্ত¡নায় উচ্ছ্বাস, নির্ভরতায় প্রতিদান, নিশ্চিত নিয়তি জেনেও ভয়ে ভয়ে অভয়দানে অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদারের যে অভিনয় ব্যঞ্জনা তা কি ভোলা যায়। অজিত নারায়ণ দাশগুপ্তরূপী দেবশঙ্কর হালদারকে ভোলা যায় না বলেই মায়ারূপী সোমা দত্তকেও মনে পড়ে। মনের মনোভূমে যেখানে পাঠকের সঙ্গে সাহিত্যিকের, বই ক্রেতার সঙ্গে বই বিক্রেতার, জ্ঞানীর সঙ্গে প্রাজ্ঞের বসবাস সেখানেই নাটক তোমার আমি ছড়িয়ে দেয় সুবাসিত তার সবটুকু নির্যাস।
×