ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চালু হয়েছে ট্রেড পোর্টাল *পেপারলেস ট্রেডের জন্যও প্রস্তুত

বাণিজ্য সহজীকরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ এগিয়ে

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ৮ অক্টোবর ২০১৭

বাণিজ্য সহজীকরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ এগিয়ে

কাওসার রহমান ॥ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এ্যাগ্রিমেন্ট বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। বিশেষ করে, বাণিজ্য সহজীকরণ চুক্তিতে নির্ধারিত ৩৮টি পদক্ষেপের অনেকগুলোই ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ট্রেড পোর্টাল চালু হয়েছে। এটির মাধ্যমে অনলাইনে বাংলাদেশের বাণিজ্য-বিষয়ক যাবতীয় তথ্য, বিধিবিধান ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা সম্ভব। কোন একটি পণ্য রফতানি করতে হলে কীভাবে বিএসটিআইর মান সনদ নিতে হয়, তা জানতে আগে একজন ব্যবসায়ীকে সংশ্লিষ্ট বণিক সমিতি ও বিএসটিআইর কার্যালয়ে ছুটতে হতো। এতে সময় ও খরচ বেড়ে যেত। এখন ঘরে বসেই ট্রেড পোর্টালে প্রবেশ করে পুরো প্রক্রিয়াটি জানা ও বোঝা সম্ভব। যদিও ট্রেড পোর্টালের নানা সীমাবদ্ধতা এখনও আছে। তবে এগুলো দ্রুত কাটিয়ে উঠে নিয়মিত হালনাগাদ করা জরুরী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাণিজ্য সহজীকরণের মূল সূত্র হলো অনলাইনভিত্তিক ইলেকট্রনিক কার্যক্রম, যা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন কারিগরি দক্ষতা ও কুশলতা। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক দেশের চেয়েই এগিয়ে আছে। কারণ বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ দ্রুত গড়ে উঠছে। সরকারী দফতরগুলোতেও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তবে দুটি বড় সীমাবদ্ধতায় বাংলাদেশে টিএফএর অর্থবহ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এর একটি হলো, সরকারী দফতরগুলোর মধ্যে চিরাচরিত সমন্বয়হীনতা এবং যথাসময়ে তথ্য-উপাত্ত ও বিধিবিধানের পরিবর্তন হালনাগাদ না করা। যে কোন এক বা একাধিক দফতর সময়মতো তাদের কাজটি না করলে পুরো প্রক্রিয়াটিই ধাক্কা খাবে। আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, টিএফএ-বিষয়ক সফটওয়্যার বিনির্মাণ ও স্থাপন করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি। অবশ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সিঙ্গেল উইন্ডো তথা একক জানালা ব্যবস্থা চালুর কাজ চলছে। এটির মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সব কাজ একটি মাত্র স্থানে ইলেকট্রনিকভাবে সম্পন্ন হবে। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইউএস এআইডিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এসব কাজে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। ২০১৯ সালের মধ্যে এটি চালু হতে পারে। বিনিয়োগ বোর্ড ও বেসরকারী কমিশনকে একীভূত করে গঠিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিআইডিএ) বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান আগামী পাঁচ বছরে ১০০-র মধ্যে নামিয়ে আনার ব্রত গ্রহণ করেছে। এটি করতে হলে টিএফএর অর্থবহ বাস্তবায়ন অপরিহার্য। উল্লেখ্য, ব্যবসা সূচকে বর্তমানে (২০১৭) বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম। উল্লেখ্য, প্রতিবেশী দেশ ভারত অতি সম্প্রতি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্ত মেনে অবাধ বাণিজ্যের দরজা আরও বেশি করে খোলার লক্ষ্যে এগোতে পথনির্দেশ স্থির করেছে। ১৬৪টি সদস্য দেশের মধ্যে ইতোমধ্যে সই হওয়া চুক্তি রূপায়ণে দেশটি সময়সীমা বেঁধে এগোনোর পদক্ষেপ নিয়েছে। চুক্তিটি রূপায়ণে গত বছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ক্যাবিনেট সচিবের নেতৃত্বে এ সংক্রান্ত একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। এ কমিটিই চুক্তি রূপায়ণের পথনির্দেশ বা ন্যাশনাল ট্রেড ফেসিলিটেশন এ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে তা বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করেছে। সরকার তা গ্রহণ করে এর বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করেছে ২০১৭-২০২০ সাল। তার মধ্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে কোন কোন প্রস্তাব স্বল্প (০-৬ মাস), মাঝারি (৬-১৮ মাস) ও দীর্ঘ মেয়াদে (১৮-৩৬ মাস) রূপায়ণ করতে হবে। ভারত সরকারের স্বল্প মেয়াদের লক্ষ্য হলো, দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় এমন পণ্য মজুদের ব্যবস্থা উন্নত করা। এ ধরনের আমদানি পণ্যকে ছাড়পত্র দিতে হবে দেশে আসার ১২ ঘণ্টার মধ্যে। রফতানি পণ্যের জন্য এই সময়সীমা ৮ ঘণ্টা। মাঝারি মেয়াদে সব তথ্য ইন্টারনেটে রাখতে হবে। একজানলা ব্যবস্থায় একটি পোর্টাল মারফত তা জানা যাবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে বাণিজ্যে বাধা ভাঙতে আরও ব্যবস্থা নিতে হবে এবং অনলাইনে বাণিজ্য সরল করতে নথিপত্র দাখিলে সময় কমাতে হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এ্যাগ্রিমেন্ট (টিএফএ) বা বাণিজ্য সহজীকরণ চুক্তি হলো বিশ্ব বাণিজ্যের প্রক্রিয়াগুলো সহজ করে সময় কমানো ও ব্যয়সাশ্রয়ী করার বৈশ্বিক চুক্তি। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি কার্যকর হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে ডব্লিউটিওর সদস্যদেশগুলো যার যার সীমান্তে আমদানি ও রফতানির পণ্যসমূহ দ্রুত ছাড় করার জন্য অভিন্ন কিছু পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে। বিশেষত, পণ্যের চালান পরীক্ষা ও শুল্কায়নের জন্য প্রধানত উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) কাস্টমস বা শুল্ক কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই প্রচুর সময় নেয়। তারা অপর্যাপ্ত দলিল ও কাগজপত্রের অজুহাতে চালান আটকে রাখে। আবার অবৈধ আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে তারা সেটা কখনও কখনও ছেড়েও দেয়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যায়, বেড়ে যায় পণ্যের দাম, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতা-ভোক্তাদের ওপরই এসে পড়ে। এই চুক্তির ফলে বাণিজ্য সহজীকরণ প্রক্রিয়ায় আমদানি-রফতানিকারকরা এ ধরনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবে। পণ্য আমদানি-রফতানি ও স্থানান্তরের (ট্রানজিট) যাবতীয় দলিলপত্র ইলেকট্রনিকভাবে প্রস্তুত ও যাচাই করা হবে। সীমান্তে শুল্ক কর্তৃপক্ষ পণ্য খালাসকালে কম্পিউটারের পর্দায় যাবতীয় তথ্য-দলিল তাৎক্ষণিকভাবে দেখতে ও যাচাই করতে পারবে। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ পরস্পরের সঙ্গে অনলাইনে যোগাযোগ রক্ষা ও দলিলপত্র তাৎক্ষণিকভাবে বিনিময় করতে পারবে। ফলে ব্যবসায়ীদের আর কাগজপত্র হাতে হাতে এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে দৌড়াতে হবে না। এতে সময় ও খরচ বাঁচবে, অবৈধ আর্থিক লেনদেন রোধ হবে। আবার বাণিজ্যবিষয়ক যে কোন তথ্য-উপাত্ত সহজেই অনলাইনে পাওয়া যাবে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করার পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২১ বছরের ইতিহাসে টিএফএই হলো প্রথম বৈশ্বিক চুক্তি। ২০১৪ সালে ডব্লিউটিও সদস্যরা সিলমোহর দেয় ওই ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এগ্রিমেন্টে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের ধারাবাহিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৯৬ সালে সিঙ্গাপুর সম্মেলনে এটি প্রথম উত্থাপিত হলেও সদস্যদেশগুলো এ নিয়ে আলোচনা পিছিয়ে দেয়। কেননা, বেশির ভাগ দেশেই তখন ইলেকট্রনিক লেনদেনের বিষয়টি ছিল অনুপস্থিত। ছিল নানা ধরনের অক্ষমতা। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশ এ বিষয়ে সক্ষমতা তৈরির দিকে মনোযোগ দেয়। এজন্য একাধিক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে। অবশেষে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বালি সম্মেলনে সদস্যদেশগুলো এই চুক্তি অনুমোদন করে। ডব্লিউটিওর বিধি অনুসারে অনুমোদিত চুক্তি সদস্যদেশগুলোর জাতীয় আইনসভায় বা সংসদে অনুসমর্থিত হতে হয়। সেই অনুসমর্থনের বা স্বীকৃতির দলিল ডব্লিউটিওকে হস্তান্তর করতে হয়। এভাবে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনুসমর্থন করলে কোন চুক্তি কার্যকর হয়, সবার জন্য পালনের আইনী বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। টিএফএ কার্যকর হতে দরকার ছিল ১৬৪ সদস্যের মধ্যে ১১০টির অনুসমর্থন। ফেব্রুয়ারি নাগাদ পাওয়া যায় ১১১টি দেশের অনুসমর্থন। যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি অনুসমর্থনকারী তৃতীয় দেশ। ২০১৫ সালের প্রথম দিকে ওবামা প্রশাসন এটি সম্পন্ন করে। এখন ট্রাম্প যদি তাঁর প্রশাসনকে এটি ফিরিয়ে নিতে বলেন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু তাতে টিএফএ কার্যকর হওয়া বন্ধ হবে না। বাংলাদেশ প্রথম দিকে এটি অনুসমর্থন না করে অপেক্ষার নীতি নিয়েছিল। তবে ২০১৫ সালে নাইরোবি সম্মেলনের পর টিএফএ অনুসমর্থনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১৬ সালে ৯৪তম সদস্য ও ১২তম এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ টিএফএ অনুসমর্থন করে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাংলাদেশ এখন কাগজবিহীন বাণিজ্যে অবদান রাখতে প্রস্তুত। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রথম দেশ হিসেবে গত ২৯ আগস্ট ইউএন-এসকাপের অধীন ‘ফ্রেম ওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন ফেসিলিটেশন অব ক্রস বর্ডার পেপারলেস ট্রেড ইন এশিয়া এ্যান্ড দি প্যাসিফিক’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী দ্রুত ই-কমার্স জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে প্রায় ৮০ ভাগ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে ২০ ভাগ তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সেবা খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এখন বেশ জনপ্রিয়। সরকারের বাণিজ্য ক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী অফিসগুলোকে অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে। সরকারী দফতরগুলোকে ই-গভর্নেন্সের আওতায় এনে পেপারলেস করা হচ্ছে।
×