ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আন্দোলনের মাধ্যমে চাপে ফেলার কৌশল নেবে

সমঝোতার প্রস্তাব নাকচ হওয়ায় বিএনপি নাখোশ

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সমঝোতার প্রস্তাব নাকচ হওয়ায় বিএনপি নাখোশ

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেয়া সমঝোতার প্রস্তাব সরকারী দলের পক্ষ থেকে নাকচ করে দেয়ায় বিএনপি নাখোশ। এ পর্যন্ত বিএনপির পক্ষ থেকে যতবারই প্রস্তাব দেয়া হয় ততবারই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা নাকচ করে দেয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি আরও কয়েক মাস সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলার কৌশল নেবে। উল্লেখ্য, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। তবে নির্বাচন বর্জন ও এ নির্বাচনকে বানচাল করতে দেশব্যাপী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে ইতিবাচক কর্মসূচী পালন করতে ব্যর্থ হয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরপূর্তিতে আবারও লাগাতার সহিংস আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটাতে না পেরে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের চাপে রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করে দলটি। এর পর থেকে শুরু হয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারী দলের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা। খোদ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে দলের সব সিনিয়র নেতা সরকার ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার কথা বারবার বলতে থাকেন। কিন্তু যতবারই বিএনপির পক্ষ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া হয় ততবারই সরকার বা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তা নাকচ করা হয়। তারপরও বিএনপি হতাশ না হয়ে এ দাবির পক্ষে সোচ্চার থাকে। কারণ বিএনপি নেতারা মনে করছেন, বারবার বলার পর কোন এক সময় সরকারী দল আওয়ামী লীগ হয়ত রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়ে নমনীয় হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রকম লক্ষণ দেখতে না পেয়ে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা নাখোশ। ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ব্যবস্থা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা সমঝোতার কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি কিন্তু সরকারের এ বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই। আশা করছি অবিলম্বে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার পদক্ষেপ নেবে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশন শেষে ২২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতার কথা নাকচ করে দেন। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে কেউ যেন এমন প্রস্তাব নিয়ে না আসে। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির অন্য নেতারাও বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেন। বিএনপির সমঝোতার প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী নাকচ করে দেয়ার পরদিন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা গণতন্ত্রের স্বার্থে সরকারকে সমঝোতার কথা বলছি। বিএনপি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল বলে সরকার সমঝোতা চায় না। তবে বিএনপি কোনকিছুর বিনিময়ে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেবে না। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপি সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার থাকবে। এ বিষয়ে সমঝোতা না হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আন্দোলন করবে। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে কোনভাবে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চায় বিএনপি। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখা, দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক মামলা থেকে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা করে ঘুরে দাঁড়াতে চায় দলটি। এজন্য সরকারকে পুরো পাঁচ বছর মেয়াদপূর্তি ও কঠোর আন্দোলনে না যাওয়াসহ বিভিন্ন শর্ত মানতে রাজি বিএনপি। তবে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা না হলে বাধ্য হয়েই তারা আন্দোলনে যাবে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার সমঝোতার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হলেও ভেতরে ভেতরে সমঝোতার চেষ্টা এবং কূটনীতিকদের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারের ওপর নানামুখী চাপ প্রয়োগ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। এজন্য দলের কিছু সিনিয়র নেতা ও ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন মহলের সঙ্গে লবিং-তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনের দেয়া নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে হলে পরপর দুবার নির্বাচন বর্জন করা যাবে না। তাই সহায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার থাকলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন হোক আর যে সরকারের অধীনেই হোক বিএনপিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। আর এজন্যই বর্তমান সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশের নিশ্চয়তা চায় বিএনপি। সরকারের সঙ্গে সমঝোতার কথা মাথায় রেখেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গত বছরের ১৮ নবেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন ও পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার বিষয়ে ১৩ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। সেই সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতারও ইঙ্গিত দেন। পরে ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপকালেও তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন ও সুষ্ঠু নির্বাচানের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন এবং এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সহযোগিতা কামনা করেন। প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানাতে থাকে। একপর্যায়ে বিএনপির এ আহ্বানের প্রেক্ষিতে তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে রাজনেতিক সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন। বান কি মুন নিজে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াার সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব জর্জ ফার্নান্দেজ তারানকোও একাধিকবার ঢাকায় এসে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে দুই দলের সিনিয়র নেতাদের একসঙ্গে বসিয়ে একাধিক বৈঠকও করেন তারানকো। কিন্তু দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে এক টেবিলে বসাতে না পারায় জাতিসংঘের এ উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে সারাদেশে কঠোর আন্দোলনের পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যখন সংলাপের আহ্বান জাননাচ্ছিলেন তখন একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফোন করেন। সেই সঙ্গে তিনি খালেদা জিয়াকে গণভবনে চায়ের আমন্ত্রণও জানান। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হওয়া ও গণভবনে না যাওয়ায় দুই নেত্রীর মধ্যে তখন সংলাপ হয়নি। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে রয়েছে চরম বেকায়দায়। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাও এখন হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে কিভাবে সরকারকে সমঝোতায় এনে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করা যায় তা নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে বিএনপি হাইকমান্ড। জানা যায়, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার শেষ চেষ্টার অংশ হিসেবে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবে বিএনপি। খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এ রূপরেখা দেবেন। তবে বিভিন্ন কারণে খালেদা জিয়ার দেশে ফিরতে বিলম্ব হবে বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে সহায়ক সরকারের প্রস্তাব তুলে ধরার পর তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে সমঝোতার জন্য সংলাপের আহ্বান জানাবেন। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার কোন বিকল্প নেই। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরবেন। এরপর ওই রূপরেখাসহ প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেয়া হবে এ নিয়ে সংলাপের জন্য। সরকার সমঝোতায় ব্যর্থ হলে আন্দোলন করেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায় করতে হবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সমঝোতা ছাড়া রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসন সম্বব নয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করলে সে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। দেশের মানুষ নির্ভয়ে ভোট দিতে চায়। এজন্যই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার প্রয়োজন। আর সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা দরকার। বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। আমরা মানুষের ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। তাই সরকারকে বলব সংবিধানের দোহাই না দিয়ে সমঝোতায় আসতে। তা না হলে বিএনপির সামনে আন্দোলনের কোন বিকল্প থাকবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাকেব ভিসি এমাজউদ্দিন আহমদ বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে। তবে আমরা চাই দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসুক। আর এজন্য সমঝোতা প্রয়োজন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরা বারবার সমঝোতার কথা বলছি। কিন্তু সরকার আমাদের এ আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না। আশা করছি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের ব্যবস্থা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পদক্ষেপ নেবে। তা না হলে দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি আবারও রাজপথে নামবে। আন্দোলন-সংগ্রাম করেই দাবি আদায় করা হবে।
×