ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বৃক্ষবান্ধবের বিদায়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বৃক্ষবান্ধবের বিদায়

প্রকৃতিপ্রেমী ও নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা আর আমাদের মাঝে নেই। তবে নিছক এটুকু বললে প্রকৃতপক্ষে তাঁর সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা হয় না। প্রকৃতির পাশাপাশি তিনি ছিলেন যথার্থ অর্থে একজন মানবতাবাদী। সর্বদাই তিনি প্রকৃতি ও মানুষকে একাকার করে মিলিয়ে দেখেছেন। আজীবন আমৃত্যু সযতেœ এই আন্তরিক বিশ্বাস লালন করেছেন যে, মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশের সন্তান; শেষপর্যন্ত সে বিলীন হয়ে যায় পঞ্চভূতে অর্থাৎ নিসর্গপ্রকৃতিতে। সুতরাং প্রকৃতি ও পরিবেশকে সর্বোতভাবে প্রযতœ ও সুরক্ষা করা প্রতিটি মানুষের জীবনের এক আদি এবং অকৃত্রিম ধ্যান-জ্ঞান ও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হওয়া অত্যাবশ্যক। মূলত এই সুদৃঢ় প্রোথিত বিশ্বাস তিনি পেয়েছিলেন জন্মমুহূর্ত থেকে। পিতা ছিলেন পেশায় কবিরাজ, চারপাশের গাছগাছালি, লতাপাতা গুল্ম, ফল-মূল, শেকড়-বাকড়-পরগাছা নিয়েই ছিল পারিবারিক কাজকারবার। এর পাশাপাশি দ্বিজেন শর্মার আশৈশব বেড়ে ওঠা ও হাতেখড়ি ঘটতে থাকে জন্মভূমি সিলেটের পাথাড়িয়া পাহাড়ের অপূর্ব ও অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশে, যার সুগভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব প্রগাঢ় স্নিগ্ধ ছায়া বিস্তার করেছিল তার ওপর জীবনব্যাপী। যে কারণে প্রায় অনিবার্য পরিণতি একজন সফল উদ্ভিদবিজ্ঞানী প্রকারান্তরে নিসর্গপ্রেমী ও পরিবেশবাদী হয়ে ওঠা। এর পাশাপাশি প্রকৃতি ও পরিবেশ তাকে যে ভালবাসা শিখিয়েছে, তা তিনি রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন মানবপ্রেমে, যা পরিণত হয়ে পর্যবসিত হয় ধরিত্রীর সুরক্ষায়। সম্ভবত নিজের মানবিক এই সত্তা ও আদর্শকে সমুজ্জ্বল রাখতেই সমর্পিত হয়েছিলেন সমতা, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নদর্শনে। এ ক্ষেত্রে তার পরম সখা ও সহায়ক হয়েছিল বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন উদ্ভিদবিদ ও নিসর্গবিজ্ঞানী, সর্বোপরি সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা ও মার্ক্সীয় চেতনা। যারা দ্বিজেন শর্মাকৃত ‘হিমালয়ে উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার’ বইটি পড়েছেন, তারা মর্মে মর্মে তা হৃদয়াঙ্গম করতে পারবেন নিশ্চয়ই। তবে এ কথাও সত্য যে, জীবদ্দশায় সব স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ছত্রখান হয়ে ভেঙ্গে যাওয়া, বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক শিবির বলয়ের ছন্দপতন হয়ত তাকে পীড়িত ও ব্যথিত করে থাকবে। তবে এর পাশাপাশি নিশ্চয়ই উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন গত কয়েক বছর ধরে প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি প্রায় সর্বস্তরের মানুষের ভালবাসা উথলে উঠতে দেখে। বিতর্ক হয়ত করাই যায়, তবে অধুনা প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় আমজনতা অন্তত সচেতন এবং বিশ্ব নেতারা নড়েচড়ে বসেছেন, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। আর এখানেই নিহিত রয়েছে প্রকৃতিবিদ ও নিসর্গপ্রেমী দ্বিজেন শর্মার আজীবন কাজের সাফল্য ও স্বীকৃতি। জয়তু দ্বিজেন শর্মা। যতদিন পৃথিবী ও নিসর্গপ্রকৃতি টিকে থাকবে, আকাশ-বাতাস-অক্সিজেন থাকবে বহমান, ততদিন তিনি বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে ও মনে, বিশেষ করে বঙ্গীয় চেতনায়। বর্তমানে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বরং বিশ্বব্যাপী প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপদাপন্ন। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, পাহাড় পর্বত কর্তন, যত্রতত্র নদ-নদীর নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে বিঘœ সৃষ্টি করে বাঁধ-ব্যারাজ ও জলবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, কয়লা-পেট্রোলসহ জীবাশ্ম জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, বায়ুম-লে যথেচ্ছ কার্বন নিঃসরণের ফলে ওজোন হোলের আয়তন বৃদ্ধির অনিবার্য পরিণতিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিশ্বকে ঠেলে দিয়েছে প্রায় মহাপবিপর্যয়ের দিকে। এহেন দুরবস্থা তথা আবহাওয়া ও জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় বিলম্ব হলেও মানুষ সচেতন হয়ে উঠেছে। গড়ে তুলেছে ধরিত্রী সুরক্ষা সম্মেলন ও সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ। গড়ে তুলেছে অর্থ তহবিল। হয়ত এই পর্যায়ে তা যথেষ্ট পর্যাপ্ত ও সমবণ্টিত নয়। তবে সেদিন সুদূর নয় নিশ্চয়ই, যেদিন এই সংগঠনটি আরও সুসংহত, সুগঠিত, শক্তিশালী, মানবিক ও ন্যায়পরায়ণ হয়ে উঠবে। সেদিন দ্বিজেন শর্মার আত্মা অবশ্যই ভরে উঠবে প্রশান্তিতে। আমরা তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের জানাই গভীর সমবেদনা।
×