ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সঙ্কট পিছু ছাড়ছে না রাজধানীর সাত সরকারী কলেজের

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সঙ্কট পিছু ছাড়ছে না রাজধানীর সাত সরকারী কলেজের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হলেও সঙ্কট পিছু ছাড়ছে না রাজধানীর সর্ববৃহৎ সাত সরকারী কলেজের। আট মাসেও স্নাতক পরীক্ষার ফল পায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা এবার আন্দোলনে নেমেছেন পরীক্ষা ফল ঘোষণার দাবিতে। রবিবার সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়ে ফল প্রকাশের দাবিতে অনশন করে লাগাতার আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এদিকে হেফাজতের চাওয়া অনুসারে পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়া প্রগতিশীল লেখকদের লেখা ফিরিয়ে না আনলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতীয় শিক্ষা সংস্কৃতি রক্ষা আন্দোলন। এর আগে গত মাসের আন্দোলনের পর পরীক্ষার তারিখ আদায় করতে সমর্থ হয়েছিলেন ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। মাস্টার্স পরীক্ষার দাবিতে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে চোখ হারান সরকারী তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান। পরে সেই পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে পরীক্ষা শুরু হয়েছে গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে। ওই আন্দোলন সফল হলেও আট মাস আগে পরীক্ষা দেয়া চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্কট কাটেনি। রবিবার থেকে তাই ফল প্রকাশের দাবিতে আন্দোলন শুরুু হয়েছে সাত কলেজে। অবিলম্বে দাবি পূরণ না হলে কঠোর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পরীক্ষা চলাকালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকার সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। এ কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নিলেও ফল দেয়ার দায়িত্ব বর্তায় ঢাবি কর্তৃপক্ষের ওপর। কিন্তু ইতোমধ্যে আট মাস চলে গেলেও তারা ফল পাচ্ছেন না। অথচ তাদের সঙ্গে পরীক্ষা দেয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ফল ঘোষণা করা হয়েছে তিন মাস আগে। এ অবস্থায় ৩৮তম বিসিএস থেকে শুরু করে অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষায় তারা আবেদন করতে পারছেন না। রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে অনশন শুরু করেন। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, আমাদের পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দাবি নিয়ে ঢাবির নতুন ভিসির কাছে গিয়েছিলাম কিন্তু তিনি যা বলেছেন তাতে মনে হচ্ছে খুব দ্রুত ফল তারা দিতে পারবেন না। ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী সুরাইয়া বলেন, আমাদের সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছিলেন তারা ফল পেয়েছেন আরও তিন মাস আগে। আমরা ফল না পাওয়ায় ৩৮তম বিসিএস থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করতে পারছি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনীহার কারণে আমরা হাজার হাজার শিক্ষার্থী আজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমরা পিছিয়ে পড়ছি। চাকরির পরীক্ষায় আবেদন করতে পারছেন না হাজার হাজার শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বলছেন, বেশকিছু জটিলতা থাকায় দ্রুত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে সাময়িক সনদ দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। ইডেন কলেজের ফিন্যান্স এ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্রী পপি রায় বলেন, কোরবানির ঈদেও বাড়ি যাইনি। পূজার ছুটিতেও বাড়ি যাব না। বাড়ি গেলে অনেকেই জিজ্ঞেস করে জব করি কিনা। আমি তাদের কিভাবে বলব এখনও পরীক্ষার ফলই প্রকাশ হয়নি। রেজাল্টের কারণে কোন চাকরির আবেদনও করতে পারি না। পপির মতো ইডেন, ঢাকা, তিতুমীর, সোহরাওয়ার্দী, নজরুল, বদরুন্নেছা এবং বাঙলা কলেজের ২০১১-১২ সেশনের সবাই এতদিনেও স্নাতক রেজাল্ট পায়নি। অনেক শিক্ষার্থী বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের রেজাল্ট জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়েছে। যা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই লজ্জাজনক। শিক্ষার্থীরা বলছেন, আন্দোলনে নামা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে চাকরিতে আবেদন করতে পারছে অথচ আমার রেজাল্ট হয়নি। এদিকে কথা বলে জানা গেছে, অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নানা সঙ্কটের কথা। পড়াশোনার গুণগত মান নিশ্চিত, সেশনজট কমানোসহ বেশকিছু সমস্যা নিরসনে ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ৭ কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এরপরও এসব কলেজে সময়মতো পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ হয়নি। একাডেমিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে, দেখা দিয়েছে সেশনজট। ঠিক সময়ে ফল প্রকাশ না হওয়ায় চাকরির অবেদন করতে পারছেন না শিক্ষার্থীরা। তাই বাধ্য হয়েই তারা আন্দোলনে নামেন। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, গত সাত মাসে তাদের যেসব ক্ষতি হয়েছে তা পোষাবে কে? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর থেকে চাপ কমাতে ২০১৪ সাল থেকে সরকার রাজধানীর বড় বড় কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়। তার বাস্তবায়ন হয় চলতি বছর জানুয়ারিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ায় এসব কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খুশিই হয়েছিলেন। তবে তা ম্লান হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। ঢাবির অধিভুক্ত হওয়ার পর থেকেই কলেজগুলোয় পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ স্থগিত রয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ সময়ে তাদের স্নাতক পর্যায়ের প্রথম থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত শতাধিক পরীক্ষার ফলাফল চূড়ান্ত করেছে। ঢাবি কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা নেয়া ও ফল প্রকাশ না করতে পারার দায় চাপাচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর। আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এজন্য ঢাবির ব্যর্থতাকেই দায়ী করছে। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, বলছেন, দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্বেই কেন আমরা ভুক্তভোগী হব? আমার গত আট বছরে যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি তা পোষাব কি করে? শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৮ মার্চ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু তাদের হয়নি সেভাবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলেও তাদের হয়নি। তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা, ডিগ্রী প্রথম ও তৃতীয় বর্ষ পরীক্ষাও স্থগিত রয়েছে। তিতুমীর কলেজের ছাত্র ফয়সাল হোসেন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ায় আমরা খুশিই হয়েছিলাম। কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকার সময়ে সেশনজট ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ায় ভেবেছিলাম সবকিছুর আমূল পরিবর্তন হবে। কিন্তু গত আট মাসে যে ক্ষতি হলো তা পোষানো কঠিন হবে। তিনি বলেন, চতুর্থ বর্ষের ফল ও মাস্টার্সের পরীক্ষা না হওয়ায় ৩৮তম বিসিএসসহ অনেক চাকরির পরীক্ষায় আবেদন করতে পারিনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সেশনের শিক্ষার্থীদের চেয়ে আমরা পিছিয়ে পড়েছি কয়েক ধাপ। বদরুন্নোসা কলেজের শিক্ষার্থী লাবনী বলেন, আমরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আজ রাস্তায় পড়ে আছি। সামনে বিসিএস পরীক্ষা। অনার্সের ফল প্রকাশ না হওয়ায় আবেদন করতে পারিনি। বিসিএস কোচিং করি তারও আন্দোলনের জন্য বন্ধ রেখেছি। বাবা টাকা খরচ করে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছেন, টাকাটাও তো জলে গেল। উদ্ভূত এ সমস্যা নিরসনের জন্য মার্চ থেকেই আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে নিজ নিজ কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা, পরে ছোট ছোট কর্মসূচী দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। এতে টনক না নড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করেন তারা। ঢাবি উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছেন। তারপরও ঢাবি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোন আশ্বাস পায়নি তারা। পরে বাধ্য হয়ে ২০ জুলাই শাহবাগে সমাবেশের ডাক দেয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচী দেয়। ওই কর্মসূচীতে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমানের চোখ নষ্ট হয়। পাঠ্যপুস্তকের কনটেন্ট সংশোধন না হলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি ॥ হেফাজতের দাবিতে পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়া প্রগতিশীল লেখকদের লেখা ফিরিয়ে না আনলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতীয় শিক্ষা সংস্কৃতি রক্ষা আন্দোলন। রবিবার সচিবালয়ের সামনে অসাম্প্রদায়িক পাঠ্যপুস্তকের দাবি ও শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে ডাকা অবস্থান ও সমাবেশ কর্মসূচীতে এ হুঁশিয়ারি দেয় সংগঠনটি। কর্মসূচী থেকে বক্তারা বলেন, দেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে এমন একটি পাঠ্যপুস্তক দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যেখানে সাম্প্রদায়িকতার স্পষ্ট প্রতিফলন পাওয়া যায়।
×