ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আখড়া রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উপাসনালয়

বরিশালের শত বছরের শংকর মঠ

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বরিশালের শত বছরের শংকর মঠ

নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে বরিশাল নগরীতে ব্রিটিশ আমল থেকে এক চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আকড়া ও রাজনৈতিক, ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে পরিচিত শ্রী শ্রী শংকর মঠ। ব্রিটিশ সরকারের আমলে শংকর মঠ ও আশ্রমে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আখড়ায় পরিণত হওয়ার খবর পেয়ে ওইসময় গোয়েন্দাদের তীক্ষè দৃষ্টি রাখার জন্য শংকর মঠের সামনেই একটি গোয়েন্দা অফিস স্থাপন করা হয়েছিল। এ প্রতিষ্ঠানটি বরিশালের ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে অসংখ্য স্মৃতিবহন করে চলছে বলেও জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। ১৯১২ সালে বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের শিক্ষক সতীশ চন্দ্র মুখোপ্যাধায় প্রায় সাড়ে তিন একর জমি ক্রয় করে তার ওপর শংকর মঠ নামে এ আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ভারতবর্ষ স্বাধীনতা আন্দোলনে এখান থেকেই রাজনৈতিক চেতনায় যুব সম্প্রদায়কে উজ্জীবিত করার কাজ করতেন। এছাড়া তিনি মহাদেব শিবের উপাসনা করতে এ আশ্রমটিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। ইংরেজী ১৯০৮ সালের শেষের দিকে তখন প-িত সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ব্রজমোহন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। ব্রহ্মচারী হিসেবে তার আচার আচরণ পোষাক পরিচ্ছেদ ছিল অতিসাধারণ। ব্রজমোহন কলেজে (বর্তমানে সরকারী ব্রজমোহন কলেজ) সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি ও ভক্তিমূলক গানের অনুষ্ঠান হতো। সংস্কৃত ভাষায় ভাগবৎ পাঠ করা হতো। যুবকরা অনেকেই এখানে উপস্থিত থাকতেন। একসময় ব্রিটিশ রাজ্যের রোষানলে পড়ে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অশ্বিনী কুমার দত্তের বিভিন্নমুখী কর্মকা-ে বাধার সৃষ্টি হতে থাকে। প্রশাসনিক বিরোধিতার ফলে যেকোন মহৎ কাজ সুষ্ঠুভাবে পালন করা সম্ভব হতো না। এটা সতীশ বাবুর মনঃপূত ছিল না। প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করা তার এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় তিনি মনের কষ্টে শেষপর্যন্ত বিএম স্কুলের চাকরি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেন। শ্রী শ্রী শংকর মঠ আশ্রমের উদ্দেশ্য ছিল স্বদেশিকতা। ভারত মাতার মুক্তি সংগ্রাম। এখানে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পূজা অর্চনা হতো। পাঠশালাও চালু করা হয়। গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে, আশ্রমের নামে এখানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। তাই গোয়েন্দারা তীক্ষè দৃষ্টি রাখার জন্য শংকর মঠের ঠিক রাস্তার ওপারে একটি গোয়েন্দা অফিস স্থাপন করেছিলেন। ১৯১৫ সালে সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় কাশীতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করেন। ১৯১৯ সালে তিনি অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করে সরাসরি বরিশালে চলে আসেন। এরপর শংকর মঠ আশ্রমের সম্পত্তি (স্থাবর অস্থাবর) পরবর্তীতে যাতে তার কোন ওয়ারিশ দাবি না করতে পারে সেজন্য আইনগতভাবে সমুদয় সম্পত্তি তিনি শংকর মঠ আশ্রমের নামে ট্রাস্টি ডিড করেছেন। ১৯২১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় থাকাকালীন সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় পরলোকগমন করেন। তার মরদেহ ৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে আনার পর তারই প্রতিষ্ঠিত শংকর মঠে সমাধিস্থ করা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গরা দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। শহরটিতে বসবাসকারী বহু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ৪৭ ও পরবর্তীতে ১৯৫০ এর দাঙ্গার ফলে শহরের বাড়িঘর ত্যাগ করে দেশান্তরিত হলেন। শহরের পরিত্যক্ত জায়গায় ঘরবাড়ি শূন্য। চারদিক খাঁ খাঁ করে এ অবস্থায় জায়গাটি ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও অস্বাভাবিকরূপ লাভ করে। এ সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার মতো কোন লোক তখন খুঁজেই পাওয়া যায়নি। জীবিতাবস্থায় সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় শংকর মঠের সম্পত্তি রক্ষার জন্য ট্রাস্টি কমিটি গঠণ করেছিলেন। যাদের নামে ডিড করা হয়েছিল তারা ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পর স্বদেশভূমি ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। বিশাল এ ভূসম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করার মতো তখন কেউ ছিল না। এককালে পুকুরের পশ্চিম পাশের পাঠাগারে ছিল মূল্যবান পুস্তকাবলী ও অবৈতনিক একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরিচালনার অভাবে সবকিছু বিলীন হয়ে যায়। খালি জায়গা গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এ ভূসম্পত্তি রক্ষার্থে এবং সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের আদর্শ ও উদ্দেশ্য যাতে বজায় থাকে এ জন্য বরিশালের বিশিষ্ট ব্যক্তিজনেরা এগিয়ে এসেছিলেন। এরমধ্যে আইনজীবী অবনী নাথ ঘোষ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী সৈনিক দেবেন্দ্র নাথ ঘোষসহ অনেকেই তাদের সঙ্গে থেকে সহযোগিতা প্রদান করেছিলেন। ১৯৮২ সালে কতিপয় ব্যক্তি মিথ্যা মামলা দিয়ে এবং রাজস্ব বিভাগের অসৎ কর্মচারীদের সঙ্গে আতাত করে শংকর মঠের পুরো সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য নানাভাবে দূরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা শুরু করলেও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। পরে এগারো সদস্য বিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয় বিপ্লবী দেবেন্দ্র নাথ ঘোষকে। পরবর্তীতে গঠনতান্ত্রিক নীতিমালা প্রণয়ন করার নিমিত্তে পন্ডিত মনীন্দ্র নাথ সামাজদার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিখিল সেনের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করার পর নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্যানেলভুক্ত সভাপতি হিসেবে এ্যাডভোকেট শান্তি রঞ্জন চক্রবর্তী ও হিমাংশু দাশ গুপ্ত নাথুকে সাধারণ সম্পাদক করে সর্বসম্মতিক্রমে ২১ সদস্যবিশিষ্ট শংকর মঠ ও আশ্রম পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। এরপর শ্রী শ্রী শংকর মঠ নবজীবন লাভ করে। নবগঠিত কমিটির দায়িত্ব লাভের পরই শুরু হয় শংকর মঠের উন্নয়নমূলক কাজ। মন্দির সংস্কার, মন্দিরের অভ্যন্তরে রাস্তা ঘাটের সুব্যবস্থা, প্রধান গেট সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্মাণ, চারপাশে প্রাচীর বেষ্টন। পুকুরের ঘাটলা বাঁধানোসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। বর্তমানে শংকর মঠের মূল মন্দিরের মাঝখানে শিব লিঙ্গ, বাম দিকে সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সমাধি এবং ডান দিকে জগৎগুরু শংকরাচার্যের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। মঠের পূর্বদিকে প্রায় এক একর সম্পত্তিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘ইসকন’ নামক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। অপূর্ব শোভাম-িত এ মন্দির, কীর্তনের জন্য আটচালা বিশিষ্ট আঙ্গিনা, খাবার ঘর, ফুল ও ফলের বাগান, পুকুর সব মিলিয়ে মনমুগ্ধকর মন্দিরে ধর্মীয় কর্মকা- চলছে যথারীতি। বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অগণিত ভক্তের সমাগম ঘটে। এখানে বসবাসকারী সাধু ব্যক্তিরা গৈরিক বসন পরে সনাতন ধর্ম দিকে দিকে ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে সারা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে ভ্রমণ করে থাকেন। শংকর মঠ সংলগ্ন রাধাশ্যামসুন্দর মন্দির (ইসকন) থেকে প্রতিবছর মহাআড়ম্বরে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে শ্রী শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। শংকর মঠে ১৯৯৯ সালে দুর্গামন্দির, ২০০৬ সালে শ্রী শ্রী কালিমাতার মন্দির এবং ২০১৬ সালে মনসা মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। মঠের মোট চারটি মন্দিরে বার্ষিক পূজাসহ এখানে প্রতিদিনই পূর্জা অর্চনা করা হয় বলে জানিয়েছেন মন্দিরের পুরোহিত শিবু চ্যাটার্জী। বিশেষ করে শারদীয় দুর্গাপূজায় এ মন্দিরে হাজার-হাজার দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে। শ্রী শ্রী শংকর মঠ পূজা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি কিশোর কুমার দে বলেন, সারা বছর এ মন্দিরে পূজা পার্বণ জাঁকজমকভাবে পালন করা হয়। তবে দুর্গাপূজা এবং শিবচতুর্দশীতে বিপুল ভক্ত এবং দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটে। এছাড়া প্রতিবছরই দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্ত মনোমুগ্ধকর এ মন্দির দেখতে আসেন। শংকর মঠ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত ট্রাস্টের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব কর্মকার বলেন, শংকর মঠ পুরনো জরাজীর্ণ অবস্থা থেকে অনেকটা উন্নত। পূর্বের জরাজীর্ণ অবস্থা না থাকলেও আর্থিক অবস্থা থেকে শংকর মঠ অনেকটা দুর্বল। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত এ মন্দিরটি যাতে আরও উন্নত করা যায় সে লক্ষ্যে তিনি সকলের সহযোগীতা কামনা করেছেন। -খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে
×