ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৬ হাজার চালকল মালিকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

১৬ হাজার চালকল মালিকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হচ্ছে

এম শাহজাহান ॥ সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়ানোর দায়ে দেশের ১৬ হাজার মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হচ্ছে। এছাড়া আমদানিকারক, পাইকার এবং খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে চাল বেচাকেনার খোঁজখবর নিচ্ছে সরকার। এ বছর দুই দফা বন্যা এবং সর্বশেষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ইস্যু নিয়ে ব্যবসায়ীরা চালের অবৈধ মজুদ বাড়িয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এ কারণেই গত এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে প্রায় ৮-৯ টাকা। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়েছে। এসব চালের অবৈধ মজুদ এবং সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর প্রমাণ রয়েছে সরকারের হাতে। আমদানি শুল্ক ২৮ থেকে নামিয়ে ২ শতাংশ করায় বেসরকারী পর্যায়ে ভারত থেকে চালের আমদানি ব্যাপক হারে বেড়েছে। এছাড়া সরকারী পর্যায়ে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে চাল কেনা হচ্ছে। জানা গেছে, দাম নিয়ন্ত্রণে এবার পাঁচ দেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। চলতি সপ্তাহে ১৫ টাকা কেজিতে ওএমএস কার্যক্রমে চাল বিক্রি করা হবে। এছাড়া অবৈধ মজুদকারীদের জেল-জরিমানা এবং লাইসেন্স বাতিল করবে সরকার। চালের অবৈধ মজুদকারীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযানে নামার আগে খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, মিল মালিক, আমদানিকারক, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জরুরী বৈঠক আহ্বান করেছেন। সরকারের কাছে যে তথ্য রয়েছে, তাতে চালের কোন সঙ্কট এ মুহূর্তে দেশে নেই হওয়ার কথাও নয়। চাল বিক্রি না করে অতি মুনাফার আশায় মজুদ করা হচ্ছে। দুই দফা বন্যায় ফসলের ক্ষয়ক্ষতি এবং রোহিঙ্গার সঙ্কটের মতো ইস্যু সামনে রেখে অবৈধ মজুদদার এবং সিন্ডিকেট চালের দাম বাড়িয়ে ফায়দা লোটার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া চাল নিয়ে উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে কিনা সেটাও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। এদিকে, সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য মতে, জাত ও মানভেদে মিনিকেট ও নাজিরশাইল জাতের প্রতি কেজি সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৬, মাঝারি মানের পাইজাম, লতা, ৫২-৫৬ এবং মোটা স্বর্ণা, বিআর-২৮ বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকায়। শুধু এক মাসের ব্যবধানে গড়ে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ১২ শতাংশের ওপরে। যদিও রাজধানীর কাপ্তানবাজার, কাওরানবাজার, নিউমার্কেট ও ফকিরাপুল বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চাল আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ভালমানের নাজিরশাইল এবং মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৬-৭২ টাকায়। এছাড়া মোটা জাতের স্বর্ণা ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাপ্তানবাজারের মেসার্স নুরু রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী খুচরা চাল বিক্রেতা নূরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বাবু বাজার ও বাদামতলীর আড়তে চালের দাম বেড়ে গেছে। আর এ কারণেই খুচরা বাজারে দাম বেশি। তিনি বলেন, পাইকারি বাজারে জাত ও মানভেদে বস্তাপ্রতি আড়াইশ থেকে ৩ শ’ টাকা পর্যন্ত দাম বেশি নেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, পাইকারি বাজারে চালের কোন সঙ্কট নেই, কিন্তু দামও কমছে না। জানা গেছে, হাওড়াঞ্চলে বন্যায় ফসল বিশেষ করে ধানের ব্যাপক ক্ষতির পর থেকে দেশে এবার চালের দাম বাড়ানো শুরু হয়। এরপর উত্তরবঙ্গসহ দেশের প্রায় ৩৫ জেলায় বন্যায় কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বাংলাদেশে। এসব সমস্যা সামনে রেখে চালের দাম বাড়ছে হু হু করে। তবে হাওড়াঞ্চলে বন্যার সময়ই চালের অবৈধ মজুদের তথ্য আসতে থাকে সরকারের কাছে। ওই সময় খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, দেশে চালের ১৬ হাজারের মতো মিল মালিক রয়েছেন যাদের আমরা কালো তালিকাভুক্ত করেছি। কালো তালিকাভুক্ত এসব মিলারের কাছ থেকে আগামী তিন বছর সরকার চাল কিনবে না। বাজারে চালের দাম বাড়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা হাওড়াঞ্চলে অকাল বন্যার পর থেকেই চাল মজুদ করেছিল। আমরা যে ক্রয় মূল্য (৩৪ টাকা) দিয়েছিলাম, বাজারের মূল্যের সঙ্গে বিরাট ফারাক ছিল। ফলে আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে টানা কয়েক বছর বাম্পার ফলনের কারণে টানা কয়েক বছর চালের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও এবার বোরো মৌসুমে আগাম বন্যায় সরকারী হিসাবে ছয় লাখ টনের মতো ধান নষ্ট হয় হাওড়ে। পাশাপাশি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীতে (১০ টাকা কেজি দরের চাল) সাড়ে সাত লাখ টন চাল বিতরণ করায় সরকারী মজুদ অনেক কমে আসে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করলে সরকার উগ্যোগী হয়। সরকারী পর্যায়ে চাল আমদানির জন্য দরপত্র দেয়ার পাশাপাশি বেসরকারী পর্যায়ে আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। সরকারী এসব উদ্যোগের ফলে দেশে চালের আমদানি অনেক বেড়েছে। এদিকে, চালের বর্তমান বাজার দর, আমদানি পরিস্থিতি এবং মজুদ সংক্রান্ত তথ্য নিরূপণে আগামী মঙ্গলবার মিল মালিক সমিতি, চাল ব্যবসায়ী সমিতি ও আমদানিকারকদের নিয়ে বৈঠক হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। ওই বৈঠকে বাণিজ্য ও কৃষিমন্ত্রীকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সরকারী তথ্য মতে চালের মজুদ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এবার বোরো ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি ৯১ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে। হাওড়ে বন্যায় নষ্ট হয়েছে ১০ লাখ মেট্রিক টন এবং সারা দেশে বিভিন্ন কারণে আরও ১১ লাখ মেট্রিক টন বোরো ফসলের ক্ষতি হয়েছে। মোট নষ্ট হয়েছে ২১ লাখ টন ধান। এর পরেও এ বছর ১ কোটি ৭০ লাখ টন বোরো ফসল ঘরে এসেছে। এছাড়া ২২ লাখ মেট্রিক টন আউশ ধান উৎপাদন হয়েছে। বোরো ও আউশসহ ১ কোটি ৯২ লাখ টন ধান পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, দেশে প্রতিদিন ৮৫ হাজার মেট্রিক টন চালের প্রয়োজন। গত ১৫ মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার মাসে আমরা এক কোটি দুই লাখ টন চাল খেয়েছি। এরপরেও আমাদের প্রায় ১ কোটি টন মজুদ চাল আছে। এ চাল মিল মালিক, ব্যবসায়ী, বাজার ও ভোক্তার ঘরে আছে। দেশে চালের কোন সঙ্কট নেই। চাল আমদানি অব্যাহত রয়েছে। কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে চালের মূল্য বাড়াচ্ছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, এবার লক্ষ্য অনুযায়ী আমরা সরকারের গোডাউনে বোরো ফসল সংগ্রহ করতে পারিনি। কারণ আমরা চালের দাম নির্ধারণ করেছিলাম ৩৪ টাকা। কিন্ত সেই দামে চাল পাওয়া যায়নি। ১২ লাখ টন বোরো সংগ্রহ করতে চেয়েছিলাম, পেয়েছি মাত্র ২ লাখ টন। বাকি ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল এ জন্যই সংগ্রহ করতে আমদানি করা হচ্ছে। পাঁচ দেশ থেকে চাল আমদানি হচ্ছে ভারত, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। দাম বাড়াতে অসাধু ব্যবসায়ীরা গুজব রটিয়ে দেয় যে, ভারত চাল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। এ ঘটনায় বাজারে দ্রুত চালের দাম বেড়ে গেছে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানান, ভারত চাল রফতানি বন্ধ করেনি। এটা নিছক গুজব। যারা গুজব ছড়াচ্ছে, শীঘ্রই তাদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, রফতানি করার জন্য ১ কোটি টনেরও বেশি চাল আছে ভারতের। অথচ একদল অসাধু ব্যবসায়ী টাকা খরচ করে চালের বাজার অস্থিতিশীল করতে ভুয়া চিঠি বানিয়ে বলেছে যে, ভারত বাংলাদেশের কাছে চাল রফতানি করবে না। অভিযান শুরু হয়েছে চালের অবৈধ মজুদ রোধে ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করা হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেশের সকল জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেয়া হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে মিল মালিক আবদুর রশিদের মিলে হানা দিয়ে ৫০ হাজার টন চাল জব্দ এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আছে। সবার সহযোগিতা পেলে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব হবে। দাম নিয়ন্ত্রণে ওএমএস চালু হচ্ছে আগামীকাল রবিবার থেকে খোলাবাজারে (ওএমএস) ১৫ টাকা কেজি দরে চাল এবং ১৭ টাকা করে আটা বিক্রি শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। প্রাথমিকভাবে বিভাগীয় শহরগুলোতে তা চালু হবে। আর ২০ সেপ্টেম্বর থেকে চালু হবে ৫০ লাখ মানুষের কাছে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কার্যক্রম, চলবে তিন মাস পর্যন্ত। এদিকে, শুল্ক কমানোর পর বেসরকারীভাবে ভারত থেকে ৬ লাখ টন চাল এসেছে এবং বেসরকারীভাবে ১৭ লাখ টন চাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। এছাড়া ভিয়েতনাম থেকে আড়াই লাখ টন চাল আমদানি হচ্ছে। ইতোমধ্যে ভিয়েতনামের ১ লাখ ৫৪ হাজার টন চাল গুদামে ঢুকেছে। বাকি চাল খালাসের অপেক্ষায় সমুদ্রে আছে। দাম নিয়ন্ত্রণে ২০ লাখ টন চাল আমদানি করবে সরকার।
×