ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সংবিধানে রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা সেটা সুপ্রীমকোর্ট নিয়ে নিতে চায় ॥ আইনমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ১ আগস্ট ২০১৭

সংবিধানে রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা সেটা সুপ্রীমকোর্ট নিয়ে নিতে চায় ॥ আইনমন্ত্রী

বিডিনিউজ ॥ নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের যে ক্ষমতা সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়েছে, তা সুপ্রীমকোর্ট ‘নিয়ে নিতে চায়’ বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আইনমন্ত্রী শৃঙ্খলা বিধির খসড়া করতে গিয়ে আপীল বিভাগের পরামর্শের ‘উল্টোটা’ করেছেন বলে প্রধান বিচারপতি ক্ষোভ প্রকাশের পর সোমবার আনিসুল হকের এ প্রতিক্রিয়া এলো। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর আইনমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধির খসড়া সুপ্রীমকোর্টে জমা দেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রবিবার তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সোমবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হাইকোর্টের হাতে দেয়া হয়েছে, আপীল বিভাগের হাতে নয়। সে অনুযায়ী শৃঙ্খলা বিধির খসড়া তৈরি করে তিনি প্রধান বিচারপতিকে দিয়েছিলেন। তারা (সুপ্রীমকোর্ট) সংশোধন করে যেটা দিয়েছিল, সেখানে দেখা গেছে আমার কাছে ডকুমেন্ট আছেৃ ১১৬ অনুচ্ছেদে মহামান্য রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা, সেটা তারা নিয়ে নিতে চায়। আমি কি করে সেটা দিই? আপনারা আমাকে রায় দিয়ে দেন, বলেন আমি তো দিতে পারি না। আইনমন্ত্রী বলেন, আমি একটা ড্রাফট পাঠিয়েছি, আপনারা (সুপ্রীমকোর্ট) কারেকশন করে দিয়েছেন। আমরা সেটার ওপর সেটুকু হাত লাগিয়েছি, যেখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ১১৬ অনুচ্ছেদ মতে। সেটা আমি শুধু বলেছি- না, এটা দেয়া যাবে না। ওনারা ওটা ফেরত পাঠিয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলির ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রীমকোর্টের হাতে না থাকায় ‘দ্বৈতশাসন’ সৃষ্টি হচ্ছে মন্তব্য করে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ১৯৭২ এর সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ ফেরানোর কথা বলে আসছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। ওই অনুচ্ছেদকে বিচার বিভাগের কাজের ধীরগতির অন্যতম কারণ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন তিনি। বর্তমান সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং সুপ্রীমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তা প্রযুক্ত হবে। সংবিধানে প্রদত্ত এই ক্ষমতায় সরকারের আইন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির পক্ষে এসব কাজ করে থাকে। আর ১৯৭২ সালের সংবিধানের এই ধারায় বলা ছিল, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি ও ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান সুপ্রীমকোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২ এর সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনে। কিন্তু ১১৬ অনুচ্ছেদে বাহাত্তরের বিধান আর ফেরেনি। মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় সুপ্রীমকোর্টের নির্দেশনায় সরকার নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা বিধির একটি খসড়া করে পাঠালেও গত বছর আপীল বিভাগ তা সংশোধনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠায়। এরপর দফায় দফায় সময় দেয়া হলেও সরকার ওই বিধিমালার গেজেট প্রকাশ না করায় বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের টানাপোড়েন সংবাদের শিরোনামেও আসে। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সরকার গেজেট প্রকাশের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। সে অনুযায়ী তিনি গত বৃহস্পতিবার খসড়া জমা দিলেও রবিবার আপীল বিভাগ তা গ্রহণ না করে ক্ষোভ প্রকাশ করে। প্রধান বিচারপতি শুনানিতে এ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হলো। উনি খসড়া দিয়ে গেলেন। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম। যদিও খুলে দেখিনি। কিন্তু এটা কী! এখানে বলা হলো ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’। এটার মানে কী? সব আইনে ব্যাখ্যা থাকে। কিন্তু এখানে কোন ব্যাখ্যা নেই। কর্তৃপক্ষ বলতে বিচার বিভাগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাখলেন। তবে তো আইন মন্ত্রণালয়ই থাকছে। এর সমাধান না হলে চলবে না। ওই খসড়া থেকে উদ্ধৃত করে প্রধান বিচারপতি বলেন, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত তারিখ থেকে গেজেট কার্যকর হবে বলা আছে। অথচ মাসদার হোসেন মামলায় নির্দেশনা আছে, সুপ্রীমকোর্ট যে তারিখ থেকে কার্যকরের পরামর্শ দেবেন, সেই তারিখ থেকে কার্যকর হবে। আমরা যেটা পাঠিয়েছি তার উল্টোটা পাঠিয়েছেন। রায়ের ষোলো বছরে হয়নি। আর এভাবে হলে ষোলো শ’ বছরেও গেজেট হবে না। প্রধান বিচারপতি বলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে আইনমন্ত্রীর দেয়া বিধিমালার খসড়ায়। তাহলে হাইকোর্টের কী থাকল? সবই তো মন্ত্রণালয়ের। ১৮৬১ সালে কলকাতা হাইকোর্ট হয়েছে; তখন থেকে হাইকোর্টের বিচারকরা নিম্ন আদালত পরিদর্শন করেন। এ ব্যবস্থাই চলে আসছে। হাইকোর্ট কেন রাখবেন? হাইকোর্ট উঠিয়ে দিন। পরে তিনি মতপার্থক্য নিরসনে বৈঠকে বসার কথা বলেন এবং বৃহস্পতিবারের মধ্যে যে কোন দিন আইনমন্ত্রী, এ্যাটর্নি জেনারেল এবং আইন মন্ত্রণালয়ের ‘এক্সপার্টদের’ আসতে বলেন। প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে সোমবার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির পরিচিতি সভা ও কর্মী সমাবেশে ক্ষোভ প্রকাশ করেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, উনি এজলাসে উঠে বললেন যে, হাইকোর্টটা তাহলে উঠিয়ে দেন। হাইকোর্ট তো বঙ্গবন্ধু করে দিয়ে গেছেন। আমরা কি করে উঠিয়ে দেব! তাহলে এ কথা কি অপ্রাসঙ্গিক নয়? নিজে গিয়ে প্রধান বিচারপতির হাতে খসড়া তুলে দেয়ার প্রসঙ্গ টেনে মন্ত্রী বলেন, আমি তো এসে ওনাকে দিয়েছি। আমি তো এমন না যে, পিয়ন বা আমার সচিবকে দিয়ে ওনার (প্রধান বিচারপতি) কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি এসে ওনাকে (প্রধান বিচারপতি) দিয়েছি। বলেছি, আপনি পড়েন, আপনি দেখেন। তার পরে যদি কোন বক্তব্য থাকে, আমাকে জানান। তারপরেও আলোচনা করব। এ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, তিনি প্রধান বিচারপতি। তার প্রতি আমার যথেষ্ট সম্মান আছে। আমি সেই সম্মান ও অধিকার রেখে প্রধান বিচারপতিকে বলতে চাই, আমি তো হাইকোর্ট সুপ্রীমকোর্ট উঠানোর কথা বলিনি। ডিসিপ্লিনারি রুলস দিয়ে হাইকোর্ট সুপ্রীমকোর্ট উঠে না। এজলাসে বসে আপনার এগুলো বলার তো দরকার হয় না। আলাপ-আলোচনা তো আমি করবই। আমি রবিবার যশোরে ছিলাম। ওনার কথা শুনে আমি ফোন করে বলেছি, আমি আসছি, বৃহস্পতিবার বসব। আমাদের সদিচ্ছা আছে। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এছাড়া প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসর, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ সরকারসমর্থক আইনজীবী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
×