ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

যমুনার ভাঙ্গনের শঙ্কা

নৌকায় জিনিসপত্র তুলে লোকজন ছুটছে নিরাপদ স্থানে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৫ জুলাই ২০১৭

নৌকায় জিনিসপত্র তুলে লোকজন ছুটছে নিরাপদ স্থানে

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ ভাঙ্গনের শব্দ শোনা যায়...। যমুনার তীর ও চরগ্রামের মানুষের দৃষ্টি নদীর ঢেউয়ের দিকে। তাদের অতীতের অভিজ্ঞতাই নদীর ঢেউকে চিনিয়েছে। বংশ পরম্পরায় নদীর গতিবিধি জেনেছে। নদীর গল্প শুনেছে। নদী কখনও শান্ত, কখনও রাগ পুষে রেখে ফুঁসে ওঠে আবার কখনও সুপ্ত থেকে বুঝতে দেয় না। নদীপারের মানুষ নদীর সঙ্গে থেকে নদীর সবই বুঝতে পারে। কেবল পারে না গোপনে কোন্ তীরে কখন আঘাত করবে। তাই এই সময়টায় ভাঙ্গনের শঙ্কায় লোকজন নৌকায় জিনিসপত্র তুলে নিরাপদ স্থানে ছুটছে। বুঝতে পারছে গুমট নদী পানি কমার সঙ্গে ভাঙ্গনের তা-ব শুরু করে দেবে। পৃথিবীতে যমুনাই একমাত্র নদী, যা সম্পূর্ণ ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। আর সব নদীর ভবিষ্যত কিছুটা হলেও বলা যায়। শুধু যমুনার বেলায় বলা যায় না। মেয়েদের চুলের বেণীর মতো এঁকেবেঁকে চলা এই নদী কোন তীরকেই ভাল থাকতে দেয় না। ‘শান্ত নদীটি পথে আঁকা ছবিটি...’ কবিতা যমুনার জন্য নয়। যমুনাকে দেখে যখন মনে হবে শান্ত ঢেউ তখন সে মোটেও শান্ত নয়। নীরব থেকে পরিকল্পনা করে কোথায় দেয়া যাবে ধ্বংসের থাবা। এই থাবা কখনও দৃশ্যমান উপরিভাগে, কখনও নদীর তলদেশে। পানিবিষয়ক একজন গবেষক বলেন, স্পিডবোটে করে যমুনার ভেতরে গিয়ে স্যাটেলাইট রিডিংয়ে দেখা গেছে, যমুনা নদী শয্যায় প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। তলদেশে কোথায় কখন ফাটল দেখা দিচ্ছে তা বোঝাই যাচ্ছে না। যমুনাতীরের লোকজন বলেন, মাঝেমধ্যেই নদীর ভেতরে বিকট শব্দ শোনা যায়। তাদের এত অতীত অভিজ্ঞতা থাকার পরও ঠাহর করতে পারেন না শব্দের উৎপত্তি কোথায়। এই শব্দই বলে দেয় যমুনার তলদেশে প্রতিনিয়ত ভূ-গঠনের পরিবর্তন হচ্ছে। বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে বহু কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনায় হার্ড পয়েন্ট ও রিভেটমেন্ট নির্মিত হয়। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই ও তাদের পরামর্শক ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ভাবতেও পারেনি এতবড় হার্ড পয়েন্টকেও যমুনা তোয়াক্কা করবে না। যে হার্ড পয়েন্টে ও রিভেটমেন্টকে শত বছরের গ্যারান্টি দেয়া হয়েছিল, তিন বছরের মাথায় যমুনা আঘাত করে তার কিছু অংশ ভেঙ্গে দেয়। ওই সময় ব্রিটিশ কনসালট্যান্ট বাংলাদেশে এসে বলেছিলেন, তার পূর্বপুরুষরা এ উপমহাদেশে ২শ’ বছর রাজত্ব করার পরও যমুনাকে চেনা তো দূরে থাক, বশে আনতেও পারেনি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আগ্রায় যে যমুনা আছে তার ধরনও একই। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণের সময় যমুনাকে কিছুটা বুঝতে পেরে বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে গতিপথ পাল্টে দিয়ে যমুনাকে চলার ভিন্ন পথ করে দেন। যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় বড় অঙ্কের অর্থে গাইড বাঁধ নির্মাণ করে যমুনার চলার নতুন পথ করে দেয়া হয়। যমুনা কখন কোথায় আঘাত করবে এ নিয়ে যমুনাপারের ও চরগ্রামের মানুষের এখন শঙ্কিত দিনলিপি। দীর্ঘদিন যমুনার সঙ্গে বাস করে যমুনাকে তারা বন্ধু মনে করেই ভালবাসে। তবে এটাও বোঝে, যমুনা যার বন্ধু তার শত্রুর কোন দরকার নেই। যমুনার থাবা রাক্ষসের মতো। প্রবীণরা যমুনাকে আজও বলে রাক্ষুসী যমুনা। গত কয়েক বছরে উত্তরাঞ্চলে বন্যা আক্রমণ করেনি। তবে প্রতি বর্ষায় যমুনা কিছু কিছু আঘাত করে কোথাও না কোথাও পার ভেঙ্গে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যমুনা থামবে না। এবার তো যমুনা টানা বৃষ্টি আর পাহাড়ী ঢলের সমর্থনে সেজে উঠছে। ঢলের বাড়তি পানি বের করে দিতে সিরাজগঞ্জের বাঁধ ভেঙ্গে দিয়েছে। বর্তমানে যমুনার পানি স্থিতি। তবে বড় শঙ্কা ভাঙ্গনের। পানি নেমে যাওয়ার সময় যমুনা শুরু করে তা-ব। একের পর এক পার ভেঙ্গে দেয়। কখন কোথায় ভেঙ্গে দেবে তার ছিটেফোঁটা আভাসও দেয় না। বাতাস হলেই যমুনাতীর ও চরগ্রামের মানুষ অনুমান করতে পারে ভাঙ্গন শুরু হবে। বাতাসের গতি দেখে ঝড় চেনা যায়। যমুনার বাতাসের গতি দেখে ভাঙ্গন চেনা যায় না। এমনও হয়েছে, লোকজন উঠানে বসে আছে; দ্রুত এক কম্পনে ভেঙ্গে দিল বসতভিটা-জমিজিরাত। যমুনার এ দৃশ্য তীরের ও চরগ্রামের মানুষের চিরচেনা। তারা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার সময় যতটা শঙ্কায় থাকে তারচেয়ে বেশি শঙ্কিত হয়ে পড়ে পানি নেমে যাওয়ার সময়টায়। পানি বেড়ে গেলে ঘরবাড়ি-জামিজিরাত ডুবে যায়। পানি সরে গেলে জেগে ওঠে। পানি কমে যাওয়ার সময় ভাঙ্গন শুরু হলে বসতভিটা-জমিজিরাত সবই কেড়ে নেয়। যমুনা সেই নদী, বয়ে যায় অচেনা দিশায় কী জানি কী সব সুর শোনায়...।
×