ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফল ও সবজি, দুই রূপের জাতীয় ফল কাঁঠাল

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৫ জুলাই ২০১৭

ফল ও সবজি, দুই রূপের জাতীয় ফল কাঁঠাল

সমুদ্র হক ॥ কাঁঠালের দুই রূপ। কাঁচা থাকলে সবজি। পেকে গেলে ফল। আমাদের দেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল এখন আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাঁঠালকে নিয়ে চলছে গবেষণা আলোচনা। চেষ্টা চলছে কিভাবে এই কাঁঠাল বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়া যায়। আফ্রিকাসহ বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলে সম্ভাব্য খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় কাঁঠালের উৎপাদন বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কাঁঠালের ঔষধি গুণাগুণ অনেক। মানব দেহে বার্ধক্য আগমনের পথ রোধ করে যৌবনকে অনেকটা সময় ধরে রাখতে কাঁঠাল অদ্বিতীয়। বৃক্ষে জন্মানো ফলের মধ্যে কাঁঠাল সবচেয়ে বড়। লম্বায় সাধারণত ১২ থেকে ৩০ ইঞ্চি। বৃত্তীয় ব্যাস ৪০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার। বিজ্ঞান নাম অর্টোক্যপাস হেক্টিরিওফাইলাস। উদ্ভিদের জাতে কাঁঠাল সহবাসী বৃক্ষ। একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল ধরে। কা-ের গোড়ার দিকে থাকে স্ত্রী ফুল। শীর্ষে থাকে পুরুষ ফুল। পুরুষ মঞ্জরির চেয়ে স্ত্রী মঞ্জরী কিছুটা লম্বা ও চওড়া হয়। ফুল ফোটার ৩-৪ দিনের মধ্যে পরাগায়ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে কাঁঠাল গর্ভধারণ করে। ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে ফুল পরিপক্বতা পেয়ে ফল ধরে। প্রতিটি গাছ ৩০ থেকে ৪০ ফুট উঁচু। প্রতিটি গাছে গড়ে বছরে দেড়শ’র বেশি কাঁঠাল ধরে। যা গাছের শাখা-প্রশাখা ছাড়াও গাছের শরীরে ধরে। প্রতিটি কাঁঠালের ওজন ১০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত হয়। কাঁচা কাঁঠালকে বলা হয় এঁচোড়। যা সবজি হিসেবে রান্না করা হয়। কাঁঠালের বহির্বিভাগ পুরু কণ্টকাকীর্ণ। অন্তর্ভাগে একটি কা- ঘিরে থাকে অসংখ্য কোয়া। কোয়ার অভ্যন্তরে থাকে বৃহদাকার বীজ। কাঁঠাল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। এর ঘ্রাণ অনেকটা কস্তুরির মতো। পাকা কাঁঠাল ফল হিসেবে খাওয়া হয়। কাঁঠালের অনেক জাতও আছে। গালা, খাজা, রসখাজা, রুদ্রাক্ষী, গোপালগন্ধা, চম্পাগন্ধা, পদœরাজ, হাজারি। বাংলাদেশে হাজারি কাঁঠাল বেশি। কাঁঠালের নামে ভিন্নতা আছে। কেরালায় ভেরিক্কা, খোজাহা। ভারতের বাংলা রাজ্যে (পূর্বের নাম পশ্চিমবঙ্গ) কাঁঠাল দুই জাতের খাজা কাঁঠাল, মজা কাঁঠাল। অন্ধ্রপ্রদেশে নাম পানাসা, ইন্দোনেশিয়ায় নাম নাংকা, থাইল্যান্ডে কানুন। থাইল্যান্ডে রাজকীয় ভোজে কাঁঠাল ও তেঁতুল অপরিহার্য। ভারতীয় উপমহাদেশে কাঁঠালের আগমন পর্তুগীজদের মাধ্যমে ১৪শ’ খ্রিস্টাব্দে। তবে দ্বিমতও আছে। কাঁঠালের আগমন অন্তত ৬ হাজার বছর আগে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় অব্দে গ্রীক দার্শনিক থিওফ্রাসটন লিখেছেন, ‘.......আরেকটি বৃক্ষ আছে যা অনেক বড়। যার ফল অসাধারণ মিষ্টি। ভারতীয় মুনি ঋষিরা এই ফল খায়।’ গ্রীক দার্শনিক কাঁঠালের কথাই বলেছেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলো বিশ্বজুড়ে কাঁঠালকে জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিকাগো বোটানিক্যাল গার্ডেনের উদ্ভিদ, জীববিদ্যা সংরক্ষণ বিভাগের প্রফেসর নাইর জেরেগা বলেছেন, গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চল কাঁঠালের অনুকূল আবাস। তবে সেসব অঞ্চলে কাঁঠালের যথাযথ ব্যবহার নেই। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্স কাঁঠালের উৎপাদন ও বাজারজাত করার উদ্যোগ নিয়েছে। গবেষকগণ বলছেন, বাংলাদেশ ও ভারতে এক সময় কাঁঠালের অনেক উৎপাদন ছিল। বর্তমানে কমেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাথন ক্রেন বলেন, কাঁঠাল গাছ বহুবর্ষজীবী হওয়ায় একবার রোপণের পর গাছ বেড়ে গিয়ে ১০ থেকে ১৫ বছর ফল দিতে পারে। ধান, গম, যব, ভুট্টা ইত্যাদি রোপণের পর যত যতœ ও পরিচর্যা সার সেচ প্রয়োগ করতে হয় কাঁঠাল সামন্য যতেœই বেড়ে ওঠে। কাঁঠাল কাঠের টিম্বার ভেল্যু অনেক বেশি। এখনও কাঁঠাল কাঠের দরজা জানালা ও আসবাবপত্রের চাহিদা বেশি। কাঁঠালের পুষ্টিমান বেশি। উন্নত বিশ্ব কাঁঠালের খাদ্য বিপণনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। পাশাপাশি ওষুধ হিসেবে কাঁঠালের গুরুত্ব বেড়েছে। কাঁঠালের স্যুপ চিপস জুস আইসক্রিমসহ নানা ধরনের খাবার তৈরি হচ্ছে। মেয়েদের গায়ের রং ফর্সা ও মুখের ব্রণ মেসতা দূর করতে দিনে নির্দিষ্ট পরিমাণ কাঁঠালের কোয়া খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। কাঁঠালের কোয়া খাওয়ার পর কোয়ার ভেতরে থাকা বীজের একটি বীজ চিবিয়ে খেলে হজম শক্তি বৃদ্ধিতে ভাল ফল দেয়। কাঁঠালের বীজ ভর্তা ভাজি ও তরকারিতেও খাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কাঁঠালের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, বি-৬, ম্যাগেনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফাইটো নিউট্রিয়েন্ট, এ্যান্টি অক্সিডেন্ট। রসানের যে যৌগগুলো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ কমায়। হৃদরোগ, ক্যান্সার, আলসারের ঝুঁকি কমায়। কাঁঠালের যে ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট আছে তা শরীরের ত্বককে সতেজ রেখে বার্ধক্যের গতি রোধ করে যৌবনকে অটুট রাখে। কাঁঠালের প্রতিটি অংশই প্রয়োজনীয়।
×