ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ধস ও পানিতে ডুবে ৬ জনের মৃত্যু

কক্সবাজারে বৃষ্টি কমলেও সরেনি বন্যার পানি চরম দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ জুলাই ২০১৭

কক্সবাজারে বৃষ্টি কমলেও সরেনি বন্যার পানি চরম দুর্ভোগ

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার থেকে ॥ টানা চারদিন পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বৃষ্টি কমে আসলেও কক্সবাজারের পাঁচ উপজেলায় বন্যার পানি সরেনি এখনও। পূর্ণিমার ভর জোয়ারের সঙ্গে বন্যার পানিতে একাকার হয়ে রয়েছে জেলার শতাধিক গ্রাম। অতি বৃষ্টিতে উখিয়া ও পার্শ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়িতে পাহাড় ধসে দুজনের মৃত্যু ঘটেছে। ঢলে ভেসে যাওয়া উখিয়ায় দুই শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে রামুতে পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ও বিকেলে ইতুন বড়ুয়ার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কক্সবাজারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঈদগাহ, চকরিয়া ও রামু। ঈদগাঁও-ফরাজী পাড়া রামুর ঈদগড় ও কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রচ- বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ী ঢলের পানির তোড়ে ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেছে চলাচলের রাস্তাসমূহ। ওসব সড়ক দিয়ে নৌকা-ভ্যান ও রিক্সায় করে মানুষজন চলাচল করতে পারলেও বন্ধ রয়েছে যানবাহন চলাচল। এতে হাজার হাজার মানুষ নিদারুন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ীসহ কর্মজীবী লোকজন চরম বিপাকে পড়েছে। বন্যায় ভেসে গেছে কয়েকটি ফার্মের হাজার হাজার মুরগি। স্রোতের টানে ভেসে গিয়ে মারা পড়েছে প্রায় ২৫টি গবাদি পশু। পোকখালী, জালালাবাদের ফরাজীপাড়া হয়ে ব্যস্ততম বাণিজ্যিক কেন্দ্র ঈদগাঁও বাজারের সঙ্গে বন্ধ রয়েছে যানবাহন চলাচল। বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ী ঢলের পানিতে রাবারড্যাম পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভাঙ্গনের ফলে লরাবাকসহ প্রধান সড়কের নানা স্থানে ভেঙ্গে গেছে বড় পরিসরে। বুধবার সন্ধ্যা ও রাতে বন্যার পানির স্রোতে সোনাইছড়ির জাফর আলমের কন্যা সামিরা আক্তার (১৪) ও মধ্যম রতœাপালং গ্রামের মৃত অমূল্য বড়ুয়ার পুত্র ইতুন বড়ুয়া (১৩)। বৃহস্পতিবার দুপুরে সামিরার ও বিকেলে শিশু ইতুন বড়ুয়ার লাশ উদ্ধার করেছে নিহতের স্বজনরা। সামিরা আক্তার উত্তর সোনাইছড়ি আয়েশা সিদ্দিকা বালিকা মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। উখিয়ার পালংখালীতে পাহাড় ধসে মোঃ রাব্বি নামে এক শিশু নিহত হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যার পর আঞ্জুমানপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, বুধবার ঘুমধুুম আজুখাইয়া ফকিরপাড়ায় পাহাড় ধসে ছেমন খাতুন (৫৫) নামে বয়োবৃদ্ধ মহিলার মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও তুমব্রু, কোনারপাড়া, নতুনপাড়া, বেতবুনিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ি সদরসহ কয়েকটি এলাকা বর্ষণের ফলে প্লাবিত হয়েছে বলে জানান ইউএনও। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে জেলা সদর, চকরিয়া ও রামুতে বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে স্থানীয়দের। ফুলেশ্বরী, বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা দেখা দেয়। প্রবল বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে ভেসে গেছে কক্সবাজার সদরের ইসলামপুর জুমনগর এলাকার একটি লেয়ার ফার্মের অন্তত ৩০ লাখ টাকার মুরগি। ফার্মের মালিক আবু তাহের জানান, ঋণ নিয়ে ফার্ম প্রতিষ্ঠা ও বিক্রি উপযোগী করে তুলে এক নিমিষে সব শেষ হয়ে গেল। পার্শ্ববর্তী লোকজন ফার্মটি বাঁচানোর চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারেনি। রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জানান, বন্যায় উপজেলার ১১ ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকার অনেকে নিজ বাড়ি ছেড়ে উঠেছে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে। প্রায় ৬০টি অভ্যন্তরীণ সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ডুবে রয়েছে বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, মন্দির, গির্জাসহ রামুর ফকিরা বাজার, বিভিন্ন হাট বাজার, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য খামার, পুকুর ও চিংড়ি ঘের। এদিকে খুনিয়া পালং পেঁচারদ্বীপ, ঈদগড় ও কাউয়ারখোপ উখিয়ার ঘোনা এলাকায় বন্যার পাশাপাশি পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জানান, বন্যাকবলিত এলাকার মধ্যে চকরিয়া ও কক্সবাজার সদরে এক হাজার খাবার প্যাকেট ও নগদ ২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন সব রকম প্রস্তুতি নিয়েছে। প্লাবিত এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। পাহাড় ধসের আশঙ্কায় লোকজন সরিয়ে নিতে হার্ডলাইনে থেকে জেলা প্রশাসন কাজ করায় বহু প্রাণহানি থেকে রক্ষা পেয়েছে পাহাড়বাসী। কয়েক দিন ধরে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে অন্তত সহস্রাধিক পরিবার সরানো হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক মোঃ আলী হোসেন জানান। বন্যায় ভেসে যাওয়া আরও দুই শিশুর লাশ উদ্ধার কক্সবাজারে রামুতে বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর (সহোদর) মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হচ্ছে ফতেখাঁরকুল চালাইন্না পাড়ার কামাল হোসেনের পুত্র মোঃ শাহিন (১০) ও মোঃ ফাহিম (৮)। বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টায় ফতেখাঁরকুল চালাইন্নাপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার নানার বাড়িতে যাওয়ার পথে ডুবন্ত রাস্তা পার হওয়ার সময় পানিতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হয় দুই সহোদর। বিকেল ৫টার দিকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সিলেট ও মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত স্টাফ রিপোর্টার সিলেট অফিস থেকে জানান, সিলেট ও মৌলবীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সিলেটের আট উপজেলায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দুর্গতদের সাহায্যে জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন, ব্যক্তি উদ্যোগেও বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটায় কানাইঘাটে সুরমা বিপদসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার, শেওলায় কুশিয়ারা বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার, আমলসীদে কুশিয়ারা বিপদসীমার ৬২ সেন্টিমিটার, শেরপুরে কুশিয়ারা ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে জেলা প্রশাসনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানা যায়, সিলেটে আট উপজেলার ৫৬টি ইউনিয়নের ৪৬৬ গ্রাম বন্যাকবলিত হয়েছে। এসব এলাকার ১৭ হাজার ৮৫৮ পরিবারের ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৫৫ জন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া ৪ হাজার ৪৯১টি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতি হয়েছে। ৪ হাজার ৩৩০ হেক্টর আউশ ধান ও আমনের বীজতলাসহ ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ২৭৫ মেট্রিক টন ত্রাণ ও ৪ লাখ ৫৫ হাজার নগদ টাকা ছাড়াও বিতরণ করা হচ্ছে শুকনো খাবারও। এদিকে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় স্বাস্থ্য বিভাগের ৭৮টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের সিভিল সার্জন ডাঃ হিমাংশু লাল রায়। এছাড়া দুর্গত এলাকায় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য উপকরণ বিতরণও করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। বন্যাকবলিত এলাকায় বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যাদুর্গত কিছু এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করছে। ২১ জুলাইয়ের মধ্যে ষান্মাসিক পরীক্ষা নেয়ার নির্দেশনা থাকার কারণে অনেক জায়গায় এমন পরিস্থিতিতেও চলছে পাঠদান। এদিকে ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যার মাঝে জলাবদ্ধতা ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে পানিবন্দী মানুষের মাঝে নানা ধরনের চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। শিশুরাও ডায়েরিয়া, শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার মতো কিছু রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মৌলবীবাজার জেলার বড়লেখা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগে কর্মরত ডাঃ মোঃ ইব্রাহিম জানান, এখনই প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন ডায়রিয়া রোগী আসছে। এছাড়াও তিনি উপজেলার কানুনগো বাজারে অবস্থিত হাকালুকি উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থানরত ৫৬ পরিবারের মধ্যে শিশুসহ লোকজন ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রয়েছেন বলে জানান। দুর্গত এলাকায় তারা পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করছেন। এদিকে কুশিয়ারা নদী এবং হাকালুকি, কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওরের পানি না কমায় মৌলভীবাজার জেলার পাঁচটি উপজেলায় প্রায় ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। বন্যাকবলিত এলাকার সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জেলার ১৪২টি প্রাথমিক ও ৪১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এখানকার মানুষ প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। কিছু পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। কুড়িগ্রামে পানিবন্দী শতাধিক গ্রামের মানুষ স্টাফ রিপোর্টার কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলাসহ সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের বজড়া বিয়ারখাতা, খেরুয়ার চর, খেদাইমারী, ফেসকার চর, নাইয়ের চর, দুইশোবিঘাসহ প্রায় ২০টি গ্রাম, অষ্টমীরচর ইউনিয়নের মুদাফত কালীকাপুর, ডাটিয়ারচর, নটারকান্দি ও দিঘলকান্দিসহ প্রায় ১৫টি গ্রাম, চিলমারী ইউনিয়নের মানুষমারার চর, আমতলার চর, কড়াই বরিশালসহ প্রায় ১০টি গ্রাম ও সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের তিনহাজারীর চর, ভগবতীর চর, খেয়ার আলগার চর, চর যাত্রাপুর, চরপারবতীপুরসহ প্রায় ১২ গ্রাম প্রায় শতাধিক গ্রামের মানুষ। এছাড়াও নতুন করে জেগে উঠা চরের ঘর-বাড়িতেগুলো প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এসব গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ।
×