ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একুশ শতকের বৃক্ষ নিম

স্বাদে তেতো, জীবন রক্ষায় মিষ্টি- প্রতিটি অংশ কাজে লাগে...

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৬ জুলাই ২০১৭

স্বাদে তেতো, জীবন রক্ষায় মিষ্টি- প্রতিটি অংশ কাজে লাগে...

সমুদ্র হক ॥ নিম স্বাদে তেতো। তবে জীবন রক্ষায় মিষ্টি। প্রতিটি অংশই মানবজীবনে কাজে লাগে। দেশে অনাদরে জন্মানো নিম সারা বিশ্বে আদরণীয় হয়ে উঠেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) দ্রব্যগুণ ও ঔষধিগুণ বিচারে নিম গাছকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। বৃক্ষ পরিবারে নিম মেহেগুনি বংশের। বর্ষজীবী চিরহরিৎ বৃক্ষ নিমের বিজ্ঞান নাম এ্যাজাড্রাইকটা ইন্ডিকা। বৃক্ষটি ৪০ থেকে ৫০ ফুট দীর্ঘ হয়। বাংলাদেশের নিমের প্রতি উন্নত দেশগুলোর আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ নিম ফাউন্ডেশন’। তবে তাদের কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে চোখে পড়ে না। নিকট অতীতে গৃহস্থ ও কিষাণ বাড়িতে আম-কাঁঠালের সঙ্গে নিম গাছ রোপণ ছিল অতি আগ্রহের। ব্যাধি ব্যামো হলে নিম গাছের ছায়ায় শুয়ে বসে থাকত লোকজন। নিমের ডালে দাঁত মাজা, নিম পাতার রস পান করা, নিম পাতায় পানি সিদ্ধ করে গোসল করাসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে। নিম কাঠের চেয়ারে বসলেও অনেক রোগব্যাধি দূর হয়ে যায়। পুকুরের চার ধারে নিম গাছ থাকলে পানি হয় স্বাস্থ্যসম্মত। চর্ম রোগ হলে বা কোথাও কেটে গেলে নিমের পাতায় গরম পানিতে ক্ষত স্থান পরিষ্কার করা হলে দ্রুত সেরে ওঠে। নিম পাতার রস প্রতিদিন সকালে পান করলে রক্ত পরিষ্কার থাকে। দেশে নিম বৃক্ষরোপণের আবহাওয়া অন্যান্য দেশের চেয়ে উপযোগী। রোপণের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, পাতা ও ছাল তেঁতো থাকায় ছাগল ও অন্য পশু পাখির উপদ্রব থাকে না। সহজেই বেড়ে ওঠে। বহু আগেই এই দেশের আনাচে-কানাচে নিম গাছ গজিয়ে ওঠার পালা শুরু হয়। নিম গাছে এক ধরনের ফল হয়। দেখতে আঙ্গুরের মতো। ভেতরে একটি বীজ। স্বাদ তেঁতো। নিমের পাতা ডাল ছালবাকর সবই কাজে লাগে। সবুজ রঙের পাতা আড়াই থেকে ৪ ইঞ্চি লম্বা। পাতার কিনারায় ১০ থেকে ১৭টি করে খাঁজ থাকে। নিমের উৎপত্তি পশ্চিম আফ্রিকা। সেখান থেকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। বাংলাদেশ ও ভারত নিম চাষের উর্বর ভূমি। নিমের সার্বিক উপকারিতা লক্ষ্য করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কৃষিজমিতে সযতেœ নিমের চাষ শুরু হয়েছে। তাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নিমের ব্যবহার বেড়েছে। ওষুধ, প্রসাধনসহ নানা পণ্যে তারা নিমের পাতা ছালবাকর তেল ব্যবহার করছে। নিমের কাঠও অনেক গুরুত্ব পেয়েছে। এই কাঠে ঘুণপোকা ধরে না। প্রাচীন কাল থেকেই নিম কাঠেই বাদ্যযন্ত্র বানানো হয়। সারা বিশ্বে ভেষজ চিকিৎসায় নিমকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ইতোমধ্যে ঢাকায় জাতীয় নিম সম্মেলন ও হারবাল ওয়ার্ল্ড এক্সপো প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় দেশে প্রতিবছর এক কোটি করে নিম গাছ রোপণ করা হবে। পাঁচ বছরে দেশে অন্তত পাঁচ কোটি নিম বৃক্ষ রোপিত হবে। এই আষাঢ় মাসে বৃক্ষরোপণ মৌসুমে নিমের চারা রোপণের হার হতাশাব্যঞ্জক। বাংলাদেশেও নিম রফতানি শুরু হয়েছে। তবে বিষয়টি এখনও মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েনি। পরিকল্পনা করে কেউ নিম গাছ রোপণ করে না। হালে হাতেগোনা কয়েকটি এলাকায় ঔষধি গাছের নার্সারিতে নিম গাছ রোপিত হতে দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে বন বিভাগ বিভিন্ন গাছের চারা রোপণের পরামর্শ দিয়ে চারা বিক্রি করে। বৃক্ষমেলারও আয়োজন করে। তবে নিম গাছের উপকারিতা ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রোপণ করলে যে রফতানি আয়ের বড় পথ সৃষ্টি হয় তার প্রচার থাকে না। কোন পরিবার ৫টি নিম গাছ রোপণ করলে ১০ বছর পাতা বীজ তেল ও ডালপালা বিক্রি করে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে পারে। নিমের খামার লাভজনক। এক একরে প্রায় ৬শ’ নিম গাছ রোপণ করার পর পরবর্তী দশ বছরে নিমের পাতা, ডাল ছাল রস বিক্রি করে আয় হবে অন্তত ৪০ লাখ টাকা।
×