ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৫১ ;###;বহু লোক আহত, অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক ;###;রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে উদ্ধার কাজে ১২ শতাধিক সেনা সদস্য ;###;সেতু ও ত্রাণমন্ত্রীর ঘটনাস্থল পরিদর্শন ;###;যোগাযোগ পুনর্প্রতিষ্ঠা ও জরুরী চিকিৎসায় সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোর

পাহাড়ে মহাদুর্যোগ

প্রকাশিত: ০৬:১১, ১৫ জুন ২০১৭

পাহাড়ে মহাদুর্যোগ

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির/মোহাম্মদ আলী, বাসু দাশ ॥ পাহাড়ের ইতিহাসে এ যেন মহাবিপর্যয়। তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির মধ্যে রাঙ্গামাটিই ভয়াবহতম জানমাল ও সহায় সম্পদের ক্ষতির শিকার। এরপর রয়েছে বান্দরবান। খাগড়াছড়িতে যৎসামান্য। গত মঙ্গলবার ভোররাত থেকে শুরু হয় বিপর্যয়। সকাল ১০টা থেকে ঘণ্টা দুয়েক সময়ের মধ্যে একযোগে বড় মাঝারি ও ছোট ধরনের পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে যায়। এর আগে রাতে ভারিবর্ষণের জের হিসেবে বিভিন্ন পাহাড়ে সৃষ্ট ফাটল থেকে ভূমিধসের এ ঘটনা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সকাল থেকেই শুরু হয় একে একে ধস নামা। এ ঘটনায় প্রাণহানি, সহায় সম্পদের ব্যাপকতা পাহাড়ের সর্বকালের রেকর্ড হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অচিন্তনীয় ক্ষতির শিকার হয়ে পাহাড়ী-বাঙালী জন অধ্যুষিত সবুজের সমারোহের পাহাড়বাসী রীতিমত হতভম্ব। শোকে বিহ্বল। সর্বত্র ভারাক্রান্ত পরিবেশ। স্বজন হারানোর বেদনায় গুমরে কাঁদছে অধিকাংশ মানুষ। এ শোক ও আহাজারি পাহাড়ী ও বাঙালীদের মধ্যে একাকার হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি, সহায় সম্পদ ও স্বজন হারারা কোন কূলকিনারাই খুঁজে পাচ্ছেন না। আকস্মিক প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ পাহাড়বাসীকে যেন সর্বস্বান্তই করে দিয়েছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে যে সময় নেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত প্রতিষ্ঠা করা না গেলে অচিরেই রাঙ্গামাটিতে বিভিন্ন ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে খাদ্য ও ওষুধ সঙ্কট মানুষের জন্য আরেক ধরনের বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে সামগ্রিক তৎপরতায় পাহাড়ে সিভিল প্রশাসনের সঙ্গে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। এছাড়া পাহাড়জুড়ে বিরাজ করছে ভূমিকম্পের আতঙ্ক। অনেকের মাঝে এ আতঙ্ক ছড়িয়েছে ব্যাপকভাবে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম জুড়ে কয়েকদিনের ভারিবর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ার তা-বে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা ও চট্টগ্রামে ভূমিধস ও পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের তোড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ সংখ্যা ১৫১-এ উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে এককভাবে রাঙ্গামাটিতেই মৃতের সংখ্যা ১০৩ জনে উন্নীত হয়েছে। অপরদিকে, চট্টগ্রামে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৩৫। বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে নতুন করে মৃত্যুর কোন খবর পাওয়া যায়নি। তবে খাগড়াছড়িতে ৬ ও বান্দরবানে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে মানুষের সহায় সম্পদের ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের অন্তত আটটি স্থানে ছোট বড় পাহাড় ধসের ফলে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে আছে। সংস্কার কাজে সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসনের সহায়তায় পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছে। এই সড়কের প্রায় ৯ কিলোমিটার রাস্তা সম্পূর্ণ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া জেলার অধীন ১০ উপজেলায়ও বিভিন্ন সড়কে অচলবস্থা রয়েছে। তবে তা বড় ধরনের নয়। এসব সড়ক সচল করতে বেশ ক’দিন সময় লাগবে বলে প্রশাসন সূত্রে আভাস দেয়া হয়েছে। পাহাড়ের রাজনৈতিক দল নামে পরিচিত ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) বুধবার থেকে ৩ দিনের শোক পালনের কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। রাঙ্গামাটিতে আহত হয়েছে শতাধিক। হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে ৮২। এদের মধ্যে ৩৯ জনের অবস্থা গুরুতর। নিখোঁজ রয়েছে অর্ধ শতাধিক। এ পর্যন্ত রাঙ্গামাটি সদর এলাকায় ৫৫, কাউখালিতে ২৭, কাপ্তাইয়ে ১৮ ও বিলাইছড়িতে ২ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। এ দুর্যোগে রাঙ্গামাটির সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা হচ্ছে ভেদভেদি, মানিকছড়ি কলেজ গেট, শিমুলতলী, পুলিশ লাইন, উন্নয়নবোর্ড এলাকা, নতুন বোর্ড এলাকা, বেতার কেন্দ্র, আসাম বস্তি ইত্যাদি। পুলিশ লাইন, কাপ্তাই নতুন রাস্তা এলাকায় ব্যাপক পাহাড় ধসের কারণে বিপুলসংখ্যক লোক আশ্রয় কেন্দ্রে অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। এদিকে, রাঙ্গামাটি শহরে রবিবার থেকে বিদ্যুত পানি সরবরাহ বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগের আওতায় ১৩৭টি স্পটের পাহাড়ে ফাটল সৃষ্টি হয়ে ধস নামায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এর ফলেই যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থেকে জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। রাঙ্গামাটি শহরের অধিকাংশ সড়কে ভাঙ্গন সৃষ্টি হওয়ায় সড়ক যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সময় নেবে বলে সড়ক বিভাগ থেকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগের কারণে আহত ও নিহতদের পরিবারের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। এদিকে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়েছে। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে উদ্ধার ও সড়ক যোগাযোগ পুনঃস্থাপনে সেনাবাহিনীর ১২শ’ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বুধবার সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ রুহুল আমিন ও চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি এসএম মনিরুজ্জামান রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। রমজান উপলক্ষে স্কুল-কলেজগুলো বন্ধ থাকায় জেলার দশ উপজেলার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এদিকে, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সরকারী বেসরকারী অফিসসমূহ অচলাবস্থার কবলে রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রীগণ তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন এবং প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। এদিকে, মঙ্গলবারের বিপর্যয়ের পর আরও ভূমিধসের আশঙ্কা করছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞগণ। রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে সেনাবাহিনীর পক্ষে পৃথক পৃথকভাবে মেডিক্যাল টিম ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যদের নিয়োজিত করা হয়েছে। অপরদিকে, রাঙ্গামাটিতে মঙ্গলবার রাতভর ছিল ভূমিকম্পের গুজব। রাতভর এ নিয়ে মাইকিংও করা হয়েছে। তবে প্রশাসন সূত্রে বলা হয়েছে, আরও ভারিবর্ষণ হলে বিভিন্ন স্থানে ভূমিধসের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে, মৃতের সংখ্যা, ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রাঙ্গামাটির মানিকছড়িতে ভূমিধসে চাপাপড়া সৈনিক আজিজুর রহমানের এখনও খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে, ভূমিধসের সঙ্গে প্রায় ৭০ ফুট নিচে মাটির সঙ্গে গভীরে চলে গেছে। এছাড়া রাঙ্গামাটিতে এখনও ২২ জন নিখোঁজ এবং ৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি থাকার কথা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে। মঙ্গলবারের ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা সরকারী ও বেসরকারীভাবে যাই হোক না কেন এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবে আরও যে বাড়বে তা নিশ্চিত। কেননা, পাহাড়ের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা যেমন তত সহজ নয়, তেমনিভাবে টেলি বা মোবাইল নেটওয়ার্কও অনেকাংশে দুর্বল। ফলে বিপর্যয়ের ঘটনার বিবরণ পেতে প্রশাসনকে বেগ পেতে হচ্ছে। রাঙ্গামাটির মানিকছড়ির ভেদভেদি এলাকায় মৃত ও নিখোঁজ থাকার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, তিনদিনের অবিরাম বর্ষণের ফলে রাঙ্গামাটি শহর ও এর আওতাধীন বিভিন্ন উপজেলার অসংখ্য পাহাড়ে ধস সৃষ্টি হয়েছে। রাঙ্গামাটি শহর সংলগ্ন এমন কোন পাহাড় নেই, যেখানে ছোট বা বড় ধরনের ধসের ঘটনা ঘটেনি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে রাঙ্গামাটি পৌরসভা, কাউখালি, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর ও রাজস্থলি উপজেলায়। এসব পাহাড়ী এলাকাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেকে নিরাপদ স্থানে সরে গেছেন প্রশাসনের আশ্রয় কেন্দ্রসমূহে। রবিবার রাত থেকে রাঙ্গামাটি শহরে বিদ্যুত না থাকায় জনজীবন বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। শহর এলাকার অধিকাংশ সড়কের বিভিন্ন স্থানে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। রাঙ্গামাটিতে স্মরণকালের ভয়াবহ প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে নিহতদের মধ্যে ৩৩ জন শিশু, ৩৬ পুরুষ ও ৩০ নারী রয়েছেন। এছাড়া রয়েছেন ৪ সেনা সদস্য। অপরদিকে, বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় বিভিন্ন পাহাড়ে ধস নেমেছে। টানা ভারিবর্ষণের কারণে সড়কে গাছ উপড়ে পড়ে এবং পাহাড় ধসে বান্দরবান-চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি সড়ক বিচ্ছিন্ন থাকার পর বুধবার থেকে পুনরায় সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঢলের পানি নেমে যাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার সকালে বান্দরবান-চট্টগ্রাম সড়কের মেঘলা এলাকায় ঝড়ো হাওয়ার কারণে গাছ পড়ে এবং পাহাড় ধসে পড়ে। সাতকানিয়ার বাজালিয়া এলাকার সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে বান্দরবানের সঙ্গে চট্টগ্রামের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অপরদিকে, রাঙ্গামাটি সড়কের উলুপাড়া এলাকায় বন্যার পানিতে একটি বেইলি ব্রিজ তলিয়ে যাওয়ায় বান্দরবানের সঙ্গে রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বুধবার সকালে ঢলের পানি নেমে যাওয়ায় উক্ত সড়কে যান চলাচল শুরু হয়েছে। বান্দরবানে পাহাড়ী ঢলে সদর এলাকার মেম্বারপাড়া, মধ্যমপাড়া, ইসলামপুর, বনানী স’মিল এলাকায়, হাফেজঘোনা, আর্মিপাড়া পানির নিচে তলিয়ে যায়। প্রশাসন সূত্রে বান্দরবানের গহীন এলাকার লুমাছড়ায় ২ জন এবং বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস মঙ্গলবার পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় কাজ করতে পারেনি। তবে মঙ্গলবার কাজ শুরু করেছে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বুধবার বান্দরবানে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। তিনি বান্দরবান শহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ত্রাণ বিতরণকালে বক্তব্য রাখেন। এ সময় তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক হানিফ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর, জেলা প্রশাসন দিলীপ কুমার বণিক, পুলিশ সুপার সঞ্জিত কুমার রায়, পৌর মেয়র ইসলাম বেবীসহ প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। জেলার দশটি আশ্রয় কেন্দ্রের ৫৩১ পরিবারকে ৫৩১ পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল এবং পাহাড় ধসে নিহত পরিবারকে ৩০ হাজার এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা করেন মন্ত্রী। অপরদিকে, টানা বর্ষণে বান্দরবানের থানছি উপজেলায় পর্যটকবাহী নৌচলাচল বন্ধ থাকার পর বুধবার থেকে সাঙ্গু নদীতে ঢলের পানি কমে যাওয়ায় ফের নৌ চলাচল শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৫ জনে উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে রাঙ্গুনিয়ায় ২৫ জন, চন্দনাইশে ৪ জন, ফটিকছড়িতে ১ জন, রাউজানে ২ জন, বাঁশখালীতে ১ জন এবং নগরীর হালিশহর ও বাকলিয়ায় ২ জন নিহত হয়েছে। এছাড়া রাঙ্গুনিয়ায় আরও ২ জন নিখোঁজ রয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়, বিভিন্ন এলাকায় ধস ও বিপর্যয়ের শিকার পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরও বর্ষণের পূর্বাভাস থাকায় পাহাড়গুলোর পাদদেশে গড়ে ওঠা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এদিকে, প্রবল বর্ষণে জমে যাওয়া পানি নামতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠেছে বিপর্যস্ত সড়ক। নিচু সড়কগুলোর অধিকাংশই যানবাহন চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুম চলমান থাকায় এর মধ্যে সংস্কারের কাজও অনিশ্চিত। তবে যত দ্রুত সম্ভব সড়কগুলোকে যান চলাচলের উপযুক্ত করা হবে বলে জানানো হয়েছে সিটি কর্পোরেশন সূত্রে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বহির্নোঙ্গরে পণ্য ওঠানামা পুনরায় শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার বন্ধ থাকার পর বুধবার সকাল থেকে ফের ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বন্দর। জেটিতে কন্টেনার ওঠানামা এবং ইয়ার্ড থেকে পণ্য ডেলিভারি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তবে দুর্যোগের কারণে শুল্কায়নের জন্য কাস্টমসে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের তোড়জোড় কম থাকায় এখনও স্বাভাবিক গতি পায়নি। চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙ্গরে নিমজ্জিত হওয়া ৩ লাইটার জাহাজ এখনও ডুবন্ত অবস্থাতেই রয়েছে। এগুলো সরিয়ে নেয়ার জন্য মালিক পক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (এডমিন এ্যান্ড প্লানিং) মোঃ জাফর আলম। বুধবার সকাল থেকে চট্টগ্রামে আবহাওয়া ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। এতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি নেমে আসে। সড়কে যানবাহন চলাচল এবং কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয় আগের মতোই। কিন্তু দুপুরের দিকে আবারও ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত জারি হওয়ায় দুশ্চিন্তার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। কেননা, টানা কয়েকদিনের বর্ষণে এর মাধ্যমেই পাহাড়গুলো নরম হয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। যদি আবারও ভারি বৃষ্টিপাত হয় তাহলে বিপর্যয় হতে পারে আরও বেশি। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা শেখ ফরিদ আহমেদ জানান, বঙ্গোপসাগরে এই মুহূর্তে কোন নি¤œচাপ কিংবা লঘুচাপ নেই। তবে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সক্রিয় থাকায় সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুম সমাগত। এ সময়ের দিকে সাধারণত ট্রানজিট পিরিয়ড বলা হয়ে থাকে। একটি ঋতুর বিদায়ের পর নতুন একটি ঋতু আসছে। সিজন চেঞ্জের এ সময়ে মেঘমালা বেশ কার্যকর থাকে। সে জন্যই এ সতর্কতা সঙ্কেত। তাছাড়া চট্টগ্রামে অতিরিক্ত বর্ষণজনিত মানবিক বিপর্যয়ের বেশিরভাগই ঘটেছে এ জুন মাসে। চট্টগ্রামসহ সারাদেশেই ভারি বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে পাহাড় ধসের আশঙ্কাও রয়েছে। ফটিকছড়ি থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা ইউনূস মিয়া জানান, বৃহত্তর ফটিকছড়ি এবং হাটহাজারীর বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি উঁচু এলাকায় হলেও নিম্নাঞ্চলে পানি বাড়ছে। এ দুই উপজেলার ওপর দিয়ে হালদা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে পাহাড়ী ঢলের তোড়ে ফটিকছড়ির পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা খিরামে কালিন্দ রাণী চাকমা (৪০) নামে এক মহিলা পানিতে ভেসে গেলে নিখোঁজ হয়। পরে অকুস্থলের অল্প দূরে ওই মহিলার লাশ উদ্ধার হয়। ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার রায় জনকণ্ঠকে জানান, বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি ভাল নয়। গ্রামীণ জনপদ নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলার আবদুল্লাহপুর, জাফত নগর, সমিতিরহাট, লেলাংসহ উত্তরাঞ্চলীয় ইউনিয়নগুলোর অনেক ক্ষতি হয়েছে। অবশ্য তিনি বুধবার দিনভর বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং খিরামে নিহতের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা এবং ৩০ কেজি চাল বিতরণ করেন। অপরদিকে, হাটহাজারীর বেশিরভাগ ইউনিয়ন পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে। অনেক স্থানে যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে। নিহত ৪ সেনার জানাজা মঙ্গলবার মানিকছড়িতে ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধার করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর নিহত মেজর মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন তানভীর সালাম শান্ত, কর্পোরাল মোঃ আজিজুল হক, সিপাহী মোঃ শাহীন আলমের লাশ ওইদিন বিকেলেই চট্টগ্রাম সিএমএইচে নিয়ে আসা হয়। রাখা হয় হিমঘরে। তাদের পরিবারের কয়েক সদস্য চট্টগ্রামে আসেন। বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিহত ৪ সেনার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সেনাপ্রধানসহ উর্ধতন সেনা কর্মকর্তা ও সিপাহীরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর হেলিকপ্টারযোগে লাশ নেয়া হয় ঢাকায়। সেখান থেকে কর্পোরাল আজিজুল হক ও সিপাহী শাহীনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অপরদিকে, নিহত মেজর মাহফুজ ও ক্যাপ্টেন তানভীরের দ্বিতীয় দফা নামাজে জানাজা ঢাকা সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ তাদের বনানী কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে। লক্ষ্মীছড়িতে পাহাড় ধসে ২ জনের মৃত্যু পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি থেকে জানান, জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম বর্মাছড়ি ইউনিয়নে পাহাড় ধসে এক নারীসহ ২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার রাতে টানা বর্ষণে বর্মাছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ খবর নিশ্চিত করেছেন। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুপার জ্যোতি চাকমা বলেন এ প্রতিনিধিকে বলেন, বর্মাছড়ি ইউনিয়নের ফুত্যাছড়া পাড়ার প্রাণকৃত্য চাকমার ছেলে পরিমল চাকমা (৩০) পাহাড় ধসে মাটিচাপায় মৃত্যু হয়। একই পরিবারের শিশু ও নারীসহ আরও ৭ জন মারাত্মক আহত হয়। ঘটনাটি মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে ঘটলেও ছড়া ও খালে পানি ভরাট হয়ে যাওয়ায় হাসপাতালে আনা সম্ভব হয়নি। বুধবার সকালে আহতদের লক্ষ্মীছড়ি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। লক্ষ্মীছড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা হলেনÑ মধ্যম বর্মাছড়ি পাড়ার সজিব চাকমার স্ত্রী রজমালা চাকমা (২৪), তার ৯ বছরের কন্যা পার্কি চাকমা ও ৬ বছরের শিশু তুষি চাকমা। সড়ক যোগাযোগ না থাকায় মারাত্মক আহতাবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন একই গ্রামের ধনঞ্জয় চাকমা (৬৫), তার স্ত্রী তিতুর বালা চাকমা (৫৫), মেয়ে সাবেত্রী চাকমা (৪০) ও সাবেত্রী চাকমার ছেলে এপিন চাকমা। দুর্গম এলাকা এবং সড়ক যোগাযোগ না থাকায় তাদের এখনও হাসপাতালে আনা সম্ভব হয়নি। পরিবারের একমাত্র সুস্থ আছেন সজিব চাকমা। তিনি এ প্রতিনিধিকে বলেন, আমি এখন নিরুপায় বাড়ির সবাই পাহাড়ের মাটি চাপা পড়ে আহত হয়েছে কিন্তু দুর্গম এলাকা ও গাড়ি চলাচলের রাস্তা না থাকায় তাদের হাসপাতালে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বাকি আরও ২ জন আহতদের নাম জানা যায়নি। তবে উপজেলা পরিষদ চেয়াম্যান জানান লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছে। এদিকে বর্মাছড়ি-কাইখালী সীমান্তে হলুদ্যাপাড়া বড়ইতলী এলাকার পতুল্যা চাকমার স্ত্রী কালেন্দ্রী চাকমা (৪৫) মাটি চাপায় মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পতুল্যা চাকমা আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ ইকবাল জানান পাহাড় ধসের ঘটনায় ২ জনের মৃত্যুর খবর শুনেছেন। ঘটনাস্থল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। তাছাড়া গাড়ি চলাচলের রাস্তা না থাকায় এবং এলাকাটি দুর্গম ও নেটওয়ার্কবিহীন হওয়ার কারণে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি জানান, ঘটনাস্থলটি রাঙ্গামাটি জেলা কাউখালী উপজেলা সীমান্তবর্তী হওয়ায় জানা যাচ্ছে না এলাকাটি খাগড়াছড়ি জেলার না রাঙ্গামাটি জেলার সীমান্তবর্তী কাউখালী উপজেলায় ঘটেছে। তিনি এ বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। লক্ষ্মীছড়ি থানার অফিসার্স ইনচার্জ আরিফ ইকবাল জানান পাহাড় ধসের ঘটনায় মৃত্যুর খবর শুনেছেন তবে এখন পর্যন্ত কেউই এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ নিয়ে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ’র শোক কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন ঢাকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদ্যুন ও মার্কিন দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জোয়েল রাইফম্যান। বুধবার ঢাকার ইইউ দফতর ও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো পৃথক বার্তায় তারা এই শোক প্রকাশ করেছেন। ইইউ রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদ্যুন জানান, বাংলাদেশ চাইলে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে ইইউ। নিহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ চাইলে এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। একই সঙ্গে তিনি এ ঘটনার গভীর শোক প্রকাশ করেন। এদিকে পাহাড় ধসে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিতে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জোয়েল রাইফম্যান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো এক শোক বিবৃতিতে জোয়েল রাইফম্যান বলেন, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে পাহাড় ধসে যে মর্মান্তিক প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর পক্ষ থেকে আমি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও উদ্ধারকারীদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করছি। আপনাদের এই দুঃখ-দুর্দশায় আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। সকল সাহসী উদ্ধারকারীকে আমরা সাধুবাদ জানাই, যারা মানুষের জীবন বাঁচাতে গিয়ে আহত হয়েছেন এবং কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
×