ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তুরাগে মা ও তিন সন্তানের মৃত্যু

পুলিশের ধারণা রেহানার শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনে এ ঘটনা ঘটেছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১১ জুন ২০১৭

পুলিশের ধারণা রেহানার শ্বশুরবাড়ির নির্যাতনে এ ঘটনা ঘটেছে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ রাজধানীর তুরাগে মা ও তার তিন সন্তান হত্যা রহস্যের কিনারা হয়নি। তবে পুলিশের সন্দেহ রেহানার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নির্যাতনের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর থেকে ঘটনাস্থল তুরাগের কামারপাড়ার কালিয়ারটেক এলাকার টিনশেড ওই বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে নিহতের শাশুড়ি মাফিয়া বেগম, ননদ কোহিনূর ও তার স্বামী মুক্তার হোসেন পালিয়েছে। ঘটনার নাটের গুরু নিহতের দেবর বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেনও গা ঢাকা দিয়েছে। এদিকে চারজনের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা হয়েছে। শুক্রবার রাতে নিহত রেহানা পারভীনের ভাই সামছুল আলম বাদী হয়ে তুরাগ থানায় নিহত রেহানার স্বামী মোস্তফা কামাল, তার ননদ কোহিনূর ও তার স্বামী মুক্তার হোসেনের নাম সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে তাদের পরিবারের লোকজনের কথা বলা হয়। পুলিশ জানায়, রেহানার স্বামী মোস্তফা কামাল, শাশুড়ি রোকেয়া বেগম, ছোট ননদ কোহিনূর, ও তার স্বামী মুক্তার হোসেন, ও দেবর দেলোয়ার হোসেনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। তুরাগ থানার ওসি মাহবুবে খোদা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জনকণ্ঠকে জানান, তিন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তবে রেহানাকে কি হত্যা করা হয়েছে। নাকি আত্মহত্যা। এখনও তা পরিস্কার নয়। তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। ওসি জানান, এ চার মৃত্যুর ঘটনায় তিনটি মোটিভ তদন্ত করা হচ্ছে। প্রথমত স্বামীর পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা। আর এই কারণে শাশুড়ি-ননদের গঞ্জনা, দ্বিতীয়ত এলাকার যে দুই প্রভাবশালীর কাছে স্বামীর বড় অঙ্কের পাওনা টাকা নিয়ে সমস্যা, তৃতীয়ত অভাব অনটনের কারণে সামাজিক ও মানসিক চাপ। পারিবারিক কলহ ও অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে রেহানা ও তার তিন সন্তানের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ওসি জানান, যা নিহতের ভাই থানায় দায়ের করা অভিযোগে উল্লেখ করেছেন। এখন তদন্ত চলছে। যে কোন মুহূর্তে নিহতের স্বামী মোস্তফা কামাল, তার মা মাফিয়া বেগম, ছোট ননদ কোহিনূর ও তার স্বামী মুক্তার হোসেন ও দেবর দেলোয়ার হোসেনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ওসি মাহবুবে খোদা জানান, ইতোমধ্যে আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মামলার আলামত ও প্রতিবেশীদের সাক্ষ্য অনুযায়ী মনে হচ্ছে, এখানে নিহতের স্বামী পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত। শ্বশুর, ননদ, তার স্বামী ও দেবর পারিবারিক কলহের মূল কারণ। মামলার এজাহারে যা আছে নিহত রেহানার ভাই সামছুল আলম মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছেন, তুরাগের কামারপাড়ার কালিয়ারটেক এলাকার টিনশেড ওই বাড়িতে রেহানা পারভীন ও তার তিন সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। সেটি মোস্তফা কামালের পৈত্রিক সম্পত্তি। সম্প্রতি (রোজার ৫-৬ দিন আগে) মোস্তফা কামালের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার উজারামপুর পৈত্রিক সম্পত্তির একটি অংশ ১৭ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। কিন্তু এ টাকার অংশ মোস্তফা কামালকে দেয়া হয়নি। এ নিয়ে রেহানার সঙ্গে মোস্তফা কামালের মা, দেবর, ননদ ও ননদের স্বামীর প্রায়ই ঝগড়া হতো। এ কারণেই তারা পরিকল্পিতভাবে চারজনকে হত্যা করতে পারে। নিহতের পরিবারের দাবি নিহত রেহানার ভাই মাহবুব জনকণ্ঠকে জানান, তুরাগের কামারপাড়ার কালিয়ারটেক এলাকার টিনশেড ওই বাড়িটি ছিল রেহানার স্বামীর মোস্তফা কামালের পৈত্রিক বাড়ি। ১৭ বছর তাদের বিবাহিত জীবনে ওরা (শ্বশুরবাড়ি লোকজন) কোনদিন আমার বোনকে শান্তি দেয়নি। প্রায় ৭ কাঠা এই জমির মধ্যে ১০টি রুমে ভাড়া চলতো। প্রতিমাসে এ ঘর থেকে প্রায় ৪০ হাজার টাকা ভাড়া ওঠতো। তিনি জানান, প্রতিমাসে এই ভাড়া টাকা মিরপুর ১০ নম্বর বোনের ছোট দেবর বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেন তুরাগের কামারপাড়া এসে ৪০ হাজার ভাড়া তুলে দিতো। পরে রেহানার শাশুড়ি মাফিয়া বেগম ও ননদ কোহিনূরসহ তাদের ভাইবোন ভাগভাটোয়ারা করে খেতেন। এই ভাড়ার টাকা বোন রেহানা ও তার স্বামী মোস্তফা কামালকে দিত না। ভাড়া তোলা নিয়ে বোন রেহানার সঙ্গে তারা শাশুড়ি, ননদ ও দেবরের অনেক ঝগড়া করত। নিহতের ভাই মাহবুব জানান, রোজার ৫-৬ দিন আগে বোনের স্বামীর গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার উজারামপুর পৈত্রিক সম্পত্তির একটি অংশ ১৭ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। কিন্তু এ টাকার অংশ বোনের স্বামীর মোস্তফা কামালকে দেয়া হয়নি। এ নিয়ে রেহানার সঙ্গে মোস্তফা কামালের মা, দেবর, ননদ ও ননদের স্বামীর প্রায়ই ঝগড়া হতো। এসব কারণে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে নিহতের ভাই মাহবুব জানান। তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তুলে মাহবুব জানান, কামারপাড়া বোনের পাশের ঘরে দুই রুম নিয়ে ননদ ও শাশুড়ি থাকতো। অথচ পাশের রুমে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা টের পায়নি। এটা কোনদিন হয় না। এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। সুষ্ঠু তদন্ত হলে অবশ্যই এ হত্যাকা-ে শ্বশুড়বাড়ির লোকজনই জড়িত বলে আশা প্রকাশ করেন নিহত রেহানার ভাই মাহবুব। তিনি অভিযোগ করেন, বোন রেহানার স্বামী মোস্তফা কামাল ছোট ভাই দেলোয়ারকে ৫-৬ বছর আগে বিদেশে পাঠানোর জন্য বড় বোনের কাছ থেকে ৬ লাখ টাকা নেয়। কামারপাড়ার জমির কাগজপত্র দিয়ে তা আনা হয়। পরে ভাই বিদেশ না যাওয়ায় সেই টাকা বড় বোনকে ফিরিয়ে দেন মোস্তফা কামাল। তারপর বড় বোন ওই জমির দলিল মোস্তফা কামালের হাতে দেয়নি। আর এই সব ঘটনার নাটের গুরু রেহানার ছোট দেবর বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেন। তাকে ও তার রেহানার ছোট ননদ কোহিনূরকে গ্রেফতার করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে জানান নিহত রেহানার ভাই মাহবুব। নিহত রেহানার ছোট বোন রোজিনা মিরপুর-১ নম্বর থাকেন। ঘটনার দিন রাতে রেহানার মৃত্যুর খবর আমাদের অন্য ভাড়াটিয়ারা দিয়েছেন বলে জানান রোজিনা। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির কেউ দেয়নি। তারাই এই হত্যাকা- ঘটিয়ে নাটক করছিলেন। তিনি জানান, ভাই এত সুন্দর সন্তানকে কোন মা এভাবে হত্যা করতে পারেনা বলে জানান রোজিনা। রোজিনা জানান, তারা ৬ বোন ৪ ভাইয়ের মধ্যে রেহানা ছিলেন পঞ্চম। ২০০০ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন তিনি। পরে সমাজকল্যাণে এমএ ডিগ্রী নেন। শাশুড়ি ও ননদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য অনেক চাকরি খুঁজেছেন। কিন্তু ভাল কোন চাকরি পাননি। পেলে শ্বশুর-শাশুড়ির অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারতো রেহানা। শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হলো। নিহত রেহানার স্বামী মোস্তফা কামাল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানান, মা, ছোট বোন কোহিনূর ও ছোট ভাই দেলোয়ারের পারিবারিক ও মানসিক চাপের কারণে স্ত্রী রেহানা ও তার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। তারা প্রতিমাসে তুরাগ কামারপাড়ার ওই বাড়ির ৪০ হাজার টাকা ভাড়া তুলতেন। আর এই টাকার ভাগ তাকে দেয়া হতো না। এমনকি রোজার কয়েকদিন আগে গ্রামের বাড়ির পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রির ১৭ লাখ টাকা ভাগও তাকে দেয়া হয়নি। এই টাকাগুলো ভাগের মোটা অংকের টাকা নিয়েছে ছোট ভাই দেলোয়ার হোসেন, তার ছোট বোন কোহিনূর। এ নিয়ে স্ত্রী রেহানার সঙ্গে তাদের ঝগড়া হতো। আর তারা রেহানাকে আজেবাজে কথা বলতো। আর এসব কারণে রেহানার ও তার তিন সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। মোস্তফা কামাল জানান, তারা কয়েক মাস ধরে অর্থ সঙ্কটে ছিলেন। বড় শান্তা কামারপাড়ায় পরশমনি ল্যাবরেটরি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ত। তার মেজ মেয়ে শেফা প্রথম শ্রেণীতে পড়াশোনা করতো। তিনি জানান, কয়েকমাস ধরে তার সংসারে অর্থ সঙ্কটে চলছিল। মেয়েদের স্কুলে বেতন দিতে পারছিলাম না। এ নিয়ে স্ত্রী রেহানা হতাশাগ্রস্ত ছিল। এই কারণে স্ত্রী এই কা- ঘটিয়ে থাকতে পারেন। চারজনকে পাশাপাশি দাফন মা ও তিনজনকে কামারপাড়া কবরস্থানে পাশাপাশি দাফন করা হয়েছে। নিহত রেহানার খালাতো ভাই মোঃ নাহিদ জানান, শুক্রবার রাতে চারজনকে পাশাপাশি দাফন করা হয়। উল্লেখ্য, শুক্রবার ভোরের দিকে পুলিশ রাজধানীর তুরাগের ইজতেমা মাঠের কাছে কামারপাড়ার কালিয়ারটেক এলাকার টিনশেড বাসা থেকে রেহানা পারভীন (৩৪), তার ছোট ছেলে ১১ মাসের মুসা বিন সাদ, বড় মেয়ে এনএম আঁখি শান্তা (১৩), মেজ মেয়ে আর এম আরিফা (৭) লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায়। পুলিশের ধারণা, রেহানা পারভীন নামে ওই নারী তার তিন সন্তানকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে নিহত রেহানার পরিবারের সন্দেহ, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে।
×