ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মেহেন্দীগঞ্জের সাত ইউনিয়নে নির্বাচন

মনোনয়ন বাণিজ্যে নয় ॥ তৃণমূলের মতামতে প্রার্থী চায় আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১০ জুন ২০১৭

মনোনয়ন বাণিজ্যে নয় ॥ তৃণমূলের মতামতে প্রার্থী চায় আওয়ামী লীগ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ জেলার একমাত্র দ্বীপ উপজেলা মেহেন্দীগঞ্জের সাত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৩ জুলাই। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষদিন আগামী ১২ জুন। নির্বাচনী ইউনিয়নগুলো হলো-মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার আন্ধারমানিক, লতা, জয়নগর, চরএকারিয়া, গোবিন্দপুর, শ্রীপুর ও আলিমাবাদ। সূত্রমতে, দলীয় প্রার্থী মনোনীত করতে গত ৪ জুন জেলা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের প্রথম সভা আগৈলঝাড়ার সেরালস্থ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। মনোনয়ন বোর্ডের সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের কর্ণধর ও জেলা মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস এমপি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা) আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ, মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ মইদুল ইসলাম, মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট মুনসুর আহম্মেদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র আলহাজ্ব মোঃ কামাল উদ্দিন। সভা সূত্রে জানা গেছে, দলের সকল ভেদাভেদ ভুলে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার চেয়ারম্যান প্রার্থীদের বিপুল ভোটে বিজয়ী করতে দলীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সূত্রে আরও জানা গেছে, সাংসদ পঙ্কজ নাথ ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মইদুল ইসলামের মধ্যে চলমান বিরোধ ভুলে মইদুল ইসলামকে প্রাথমিকভাবে সাবধান করে সাংসদ পঙ্কজ নাথের পাশে থেকে আগামী নির্বাচনগুলোতে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ নির্দেশ প্রদান করেছেন। একইসঙ্গে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, দলের দুর্দিনের প্রকৃত ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতারাই মনোনয়ন পাবেন। যারা দলে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তাদের দলীয় মনোনয়নের কোথাও নাম রাখা যাবে না। আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ আরও বলেন, যাদের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে দলীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর সাংগঠনিক এ কঠোর নির্দেশে পুরো মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থকরা জানান, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে দলীয় প্রার্থী মনোনীত করা হলে উপজেলার সাত ইউনিয়নের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা শতভাগ বিজয় অর্জন করতে পারবে। নেতাকর্মীরা আরও জানান, ইতোমধ্যে নৌকার টিকেট পেতে চারদলীয় জোটের সাবেক শরিক দলের কতিপয় হাইব্রিড নেতারা বসন্তের কোকিলের ন্যায় নিজ নিজ এলাকায় ফিরে মনোনয়ন পেতে কোটি টাকার মিশন নিয়ে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। এদের মধ্যে পরিবহন ব্যবসায়ী ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতনের একাধিক অভিযোগও রয়েছে। ওইসব হাইব্রিড নেতাদের দলীয় মনোনয়ন দেয়া হলে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায় পূর্বের ন্যায় এবারও আওয়ামী লীগকে চরম খেসারত দিতে হবে বলেও তৃণমূল নেতাকর্মীরা উল্লেখ করেন। বিশেষ অনুসন্ধান এবং আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীরা জানান, মেহেন্দীগঞ্জের যে সাত ইউনিয়নে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তারমধ্যে দলীয় প্রার্থী হিসেবে জনপ্রিয়তায় শীর্ষে রয়েছেন আন্ধারমানিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক লিটন, লতা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান নেহাল, চরএকারিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন তালুকদার, আলিমাবাদ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ শহিদুল ইসলাম, গোবিন্দপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন তালুকদার, শ্রীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহামুদ হাসান, জয়নগর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম। সূত্রমতে, উল্লেখিত প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন দেয়া হলে নৌকার শতভাগ বিজয় নিশ্চিত হবে। নতুবা মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলায় পূর্বের ন্যায় এবারও আওয়ামী লীগকে চরম খেসারত দিতে হবে। বিপাকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ॥ গত ২৩ মে মেহেন্দীগঞ্জের চানপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মইদুল ইসলামের মধ্যে চরম বিরোধ দেখা দেয়। যা পরবর্তীতে সংঘাতে রূপ নেয়। ওই ঘটনার জের ধরে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বরিশাল জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মইদুল ইসলাম ২৩ মে জেলা পরিষদে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতার সময় বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের সরকার দলীয় এমপি পঙ্কজ নাথের নির্দেশে বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দিয়ে ১১ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। দলীয় মনোনয়ন পেতে প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি পেতে পঙ্কজ নাথ এ কাজ করেছেন। আপত্তিকর এ সংবাদ সম্মেলনের পর মইদুল ইসলাম দলীয় নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়লেও বিরোধী শিবির থেকে পেয়েছেন সাধুবাদ। মইদুলের বক্তব্যের রেশ ধরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আমরা তখনই বলেছি সরকারী দলই জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। শাহবাগে ২০১৪ সালে একজন আওয়ামী লীগ নেতা নিজ পরিবহনে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে ১১ জনকে হত্যার ঘটনার সত্যতা এখন আরেক আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে। সূত্রমতে, মইদুলের দেয়া বক্তব্যে বেশ উত্তাপ ছড়ায় রাজনীতিতে। তবে মইদুলের বক্তব্যে আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। ওই সময় মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মইদুল ইসলামকে দলীয় সকল পদ থেকে বহিষ্কারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। এছাড়া মইদুল ইসলামের দেয়া আপত্তিকর বক্তব্যের বিরুদ্ধে গত ২৫ মে মেহেন্দীগঞ্জে সংবাদ সম্মেলন করেছেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ। ওই সম্মেলনে মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম ভুলু বলেন, চারদলীয় জোটের শরিকদল থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করা মইদুলের বক্তব্যে আওয়ামী লীগ বিব্রত। মইদুলের আপত্তিকর বক্তব্যে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, মইদুল বিএনপির হাতে সমালোচনার অস্ত্র তুলে দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপজেলার চানপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সেলিম ঢালী বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর তাদের ইউনিয়নের তৎকালীন বিএনপির ক্যাডার মাহে আলমের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নেতাকর্মী ও তাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট এবং মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। সম্প্রতি মাহে আলম আওয়ামী লীগে যোগদান করার পরপরই সদ্য সমাপ্ত চানপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা ও মনোনয়ন বোর্ডের নেতৃবৃন্দের ভুল বুঝিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে মইদুল তাকে দলীয় প্রার্থী করেন। এ জন্য তৃণমূল নেতাকর্মীদের কোন মতামতই গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি কোন নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সাথে প্রার্থী যোগাযোগ পর্যন্ত করেননি। ফলে ক্ষোভে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তাকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ নাথ বলেন, আমি বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোটের শরিক দল থেকে উড়ে এসে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হইনি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে যখন আমি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকেই বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা শহিদ খান ও জাহাঙ্গীর কবির নানক ভাইয়ের হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছি। সেই থেকে অদ্যাবধি দলের সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে যেভাবে বলেছেন সেভাবেই আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রেখে যাচ্ছি।
×